মানব পাচারের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফে যেন তৈরি হয়েছে এক বিশেষ জায়গা। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের তুলাতলী-লম্বরী ও বাহারছড়া কচ্ছপিয়া নৌ ঘাটে অবস্থান এ জায়গার। পাচারকারীদের কাছে এ মেরিন ড্রাইভ নৌকা ঘাট এলাকাটি এখন মানব পাচারের এয়ারপোর্ট হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয় ডাকাত, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, অস্ত্রধারী ও হত্যা বহু মামলার আসামিসহ অপরাধ জগতের দুর্ধর্ষ সদস্যরা সিন্ডিকেট করে মানব পাচারের জন্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তুলাতলী ও লম্বরী ঘাট। এখান থেকে অবৈধভাবে মানুষ পাঠানো হয় মালয়েশিয়ায়।
মাঝেমধ্যে পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক দিয়ে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবারও শুরু করে মানব পাচার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে দীর্ঘদিন পাচার প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল, তবে এখন আবার মানব পাচারের কাজ শুরু হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন রাত ৮টার পর এসব ঘাট দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে। মানুষ মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশে জড়ো করার খবর পুলিশ, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডকে দিলেও কেউ পাত্তা দেয় না বলে তারা জানান। বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত দেয়ার পর কোনো প্রতিকার হয়নি।
সম্প্রতি রাতে বাহারছড়া কচ্ছপিয়া নৌ-ঘাটে ছোট্ট নৌকা নিয়ে মানুষ পাচার করা হচ্ছিল, এক ব্যক্তি তাতে বাধা দিতে গেলে পাচারকারীরা গুলি ছোড়ে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাতে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে আসেন।
গুলিবিদ্ধ হাওয়া হারুন রশিদ বলেন, আমরা দুই ভাই মিলে শখের বশে মাছ ধরতে গেছি। মাছ ধরে ফেরার সময় সাগরের তীরে অসংখ্য মানুষ চোখে পড়ে, তখন দেখি তারেকের বড় ট্রলারে তুলে দেয়ার জন্য ১০/১২টি ইঞ্জিন নৌকা নামানো হচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখার জন্য লাইট মারলে আমাদের দুজনের ওপর গুলি করে দালালরা।
তিনি বলেন, আমাকে যে গুলি করছে সে হচ্ছে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কেফায়েত উল্লাহ। গত কয়েকদিন আগে তাকে অস্ত্রসহ পুলিশ আটক করছে, কিন্তু পুলিশ টাকা খেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমি ওদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, আমার ওয়ার্ডে কচ্ছপিয়া ঘাটে গত সোমবার মানব পাচারকারীদের গুলিতে দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।তা রা এখন চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে।
তিনি বলেন, এ অবৈধ কাজ আমরা বাধা দিলে উল্টো আমাদের হুমকি দিয়ে থাকে। তবে এক দিন রাতে ঘাট দিয়ে লোক পাচারের কথা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে মোবাইলে জানালে তিনি দেখছি বলে জানান। পরে আবার জানালে তিনি আমাকে উল্টো বলেন নীরব থাকেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফ মহেশখালী পাড়া ও তুলাতলী, লম্বরী ঘাট, বাহারছড়া কচ্ছপিয়া এলাকায় চিহ্নিত প্রায় দু ডজন সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঘাট দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চলছে প্রতিরাতে। এসব ঘাটে সবসময় ১০/১২টি ইঞ্জিন নৌকা সব সময় ব্যস্ত থাকে এই কাজে। প্রতিদিনই প্রচুরসংখ্যক মানুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে সাগরপথে। টেকনাফ থানা ও বাহারছড়া ফাঁড়ির পুলিশ মানব পাচার কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ লম্বরী ঘাটের সভাপতি ফেরুজ আহমদ বলেন, আমার ঘাট দিয়ে এসব কাজ হচ্ছে, তাই আমি ঘাটের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করছি। প্রতিদিন আমার ঘাট দিয়ে মানব পাচার হচ্ছে এটা অস্বীকার করতে পারব না।
তিনি বলেন, আমিসহ অনেক মানুষ এ কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছে না। পুলিশকে আমি এ বিষয়ে কয়েকবার জানিয়েছি। কেন তারা অবহেলা করতেছে আমি এটা বুঝতে পারতেছি না। এ কাজ বন্ধ করার জন্য আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার বন্ধ ছিল। হঠাৎ আবার সাগরপথে যত লোক মালয়েশিয়ায় পাচার হচ্ছে, এর বেশির ভাগই আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম দিয়ে। এত বছর ধরে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেছি এবং উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে কয়েকবার এ বিষয়ে কথা বলছি। যারা এ অপরাধ ঠেকাবে তারাই যদি অপরাধে শামিল হয় তখন বলার কী আর থাকে বলুন! আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি কঠোর হতো এ মানব পাচার বন্ধ হতো।
বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়াগামী একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান অবস্থায় দেখে জেলেরা নিয়ে আসেন টেকনাফ মহেশখালী পাড়া নৌকা ঘাটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জহির আহমদ বলেন, সাগরে যাত্রীবাহী একটি মালয়েশিয়াগামী ট্রলার ভাসমান দেখে জেলারা টেনে কূলে নিয়ে আসেন। ট্রলারে দেড় শ মতো যাত্রী ছিলেন। সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বসবাসকারী। এর মধ্য বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ঘাটে একটি ফিশিং ট্রলার ভাসমান রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর অভিযান চালানো হবে। এই কাজে সহযোগী দুষ্ট পুলিশ সদস্যদের তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের তুলাতলীর মো. আব্দুল লতিফ বলেন, এতদিন মানব পাচারে জড়িত ছিল চিহ্নিত দালাল। এখন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা মানব পাচারের কাজ করছে। তারা অপহরণ কাজে ও জড়িত আছে। তাদের নিজস্ব বাহিনী ও অস্ত্র আছে। তারা অত্যন্ত গোপনে লোকজনকে প্রলোভনে ফেলে পাচার করে দিত। কিন্তু পুলিশ এসব চিহ্নিত পাচারকারীদের ধরে না। এখন তাদের সাথে যোগ দিয়েছে এলাকার পলাতক দুর্ধর্ষ অপরাধীরাও। তাই প্রকাশ্যে চলছে পাচারকাজ।
মানব পাচার কারা জড়িত তা নিয়ে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে। তারা হলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিলের আলম মেম্বারের ভাই শামসুল আলম ওরফে কালা বাম্বু, তুলাতলী গ্রামের আনজুল মাঝির ছেলে ইয়াছিন, ইয়াছিন সিন্ডিকেটের সদস্য দক্ষিণ লম্বরীর আমির আহমেদর ছেলে ফায়সাল, আব্দু সমদের ছেলে সাইফুল, দরগারছড়া ঝলু সওদাগরের ছেলে মো. জুবায়ের, উত্তর লম্বরীর মো. শরীফের ছেলে দোকানদার নুরুল আমিন, দক্ষিণ লম্বরী মৃত্যু হাফিজুর রহমানের ছেলে সাইফুল, আব্দুল মুনাফের ছেলে মো. নুর, মহেশখালী পাড়ার আজিজুল হক, তুলাতলী গ্রামের মুজাফ্ফার ছেলে ছৈয়দুল বশর ওরফে গুরাপুতু, তার সহোদর নুরুল বশর ওরফে কালা ভাই, হাফেজ আহমেদের ছেলে শফিক, জসীম, রোহিঙ্গা রফিক, নতুন পল্লান পাড়ার মৃত মুহাম্মদের ছেলে বশির আহমেদ, মৃত আলী আহমেদর ছেলে আজিজুল হক আজু, শাহপরীরদ্বীপের ছৈয়দ উল্লাহ, বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া নুর হোসেনের ছেলে কেফায়েত উল্লাহ, ওমর আকবরের ছেলে জসীম, মো. হারুন, মো. জলিলসহ আরও অনেকে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে লম্বরী, উত্তর লম্বরী মহেশখালী পাড়া ঘাট ও কচ্ছপিয়া নৌকা ঘাটে দেখা যায়, ১০/১২টি ফিশিং বোট নোঙর করে রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক জানান, নোঙর করা বোটগুলো সারারাত লোকজনকে গভীর সাগরে নিয়ে মালয়েশিয়াগামী বড় জাহাজে তুলে দিয়ে আসে।
স্থানীয় তুলাতলী এলাকার বাদশা ও ইউনুস বলেন, আমরা সাগরের কাছাকাছি ছোট নৌকায় মাছ শিকার করে সংসার চালাই। আর মাঝারি নৌকা মৎস্যশিকার করে না। এগুলো মানুষপাচার করে। সাগরের এসব নৌকার আনা গোনা বেশি রয়েছে। সেসব ট্রলারে থাকা মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের বেশি নির্যাতন করা হয়। সাগরের মাঝে মাঝে তাদের চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পাওয়া যায়।
মানব পাচারের শিকার হয়ে মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে আটক ছিলেন টেকনাফের আব্দুল আমিন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা হালিমা বলেন, ‘আমার ছেলেকে মিয়ানমারের জেলখানায় আটকে রেখে অনেকদিন নির্যাতন করা হচ্ছিল এবং আমাকে ফোন করে মুক্তিপণের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছে দালাল চক্র। আমি উপায় না পেয়ে ঘরের জমি বিক্রি ৩ লাখ ৫০ টাকা দিয়ে ফেরত আনছি বাংলাদেশে।’
এ বিষয়ে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, এ কাজ বন্ধ করার জন্য সবাইকে জানিয়েছি এবং বিজিবি, কোস্টগার্ডকে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।