খাদ্যাভ্যাস একটি জাতির সংস্কৃতির অংশ। বাঙালির পরিচয় যেমন মাছে ভাতে! এর পেছনে কারণও রয়েছে ঢের। নদীমাতৃক বাংলাদেশে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। এ দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ধান চাষের উপযোগী। ভাত মাছের এ প্রাচুর্যতাই ছিল যুগ যুগের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনের কারণ। অবশ্য প্রধান খাদ্য বাদ দিয়ে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে বহুবার। বিশেষ করে ঢাকাই খাবারের তালিকা সেই প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাক্ষী ঢাকার চারশ বছরের সংস্কৃতির ইতিহাস বলে আদিকাল থেকেই অত্যন্ত ভোজনরসিক ছিল ঢাকাইয়ারা। প্রাচীন নগরী ঢাকার অধিবাসীদের রসনাতৃপ্তিতে বহুমুখী সংস্কৃতির সংমিশ্রণে যোগ হয়েছে নিত্যনতুন স্বাদ। ঐতিহাসিক খাদ্যের বিশাল তালিকায় মোগল খাদ্যাভ্যাসভিত্তিক ঢাকাই খাবারের প্রাধান্যই বেশি। এছাড়া ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও ঘটেছে ঢাকাবাসীর খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তন।
যুগে যুগে ঢাকাই খাবার
প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতির আগমন ও তাদের রুচিবোধের সাথে বাঙালি খাবারের স্বাদ মিশে সৃষ্টি হয়েছে ঢাকাই সংস্কৃতির পরিমার্জিত রূপ। সুলতানি আমলে ঢাকার খাদ্যাভ্যাসে ছিল আফগান-তুর্কির প্রভাব। তারপর আসে মোগলরা। মোগলদের সাথে উত্তর ভারতীয়সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ আসে এ দেশে। এসময় বিভিন্ন পেশাজীবী এলেও সুবেদাররা চলে যাওয়ার পর থেকে যায় তারা। পরবর্তীতে বিয়েশাদির মাধ্যমে পারস্পরিক সংস্কৃতি আদান প্রদানের পাশাপাশি ঢাকার খাবার ও খাদ্যাভ্যাসে নিয়ে আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন।
মোগল ঢাকার খাদ্য সংস্কৃতি ছিল সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। অত্যন্ত ভোজনরসিক মোগলরা খাবার নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতেন। কোন খাবারের স্বাদ কীভাবে বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। মোগলরা কাবাবের জন্য যে গরু ব্যবহার করতো তাকে জাফরান খাওয়াতো নিয়মিত! এতে মাংসের মধ্যে একধরনের সুগন্ধ এসে স্বাদ বাড়িয়ে দিতো কাবাবের। মোগল খাবারের জন্ম স¤্রাট আকবরের রসুইঘরে বলে প্রচলিত আছে। তার শাহী রন্ধনশালায় নানা দেশের নানা জাতের বাবুর্চি ছিল। এ সময় ঢাকাই খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয় বেশকিছু সুস্বাদু ও মুখরোচক খাবার। এসব খাবার যখন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয় তখন লোভনীয় স্বাদের কারণে লুফে নেয় সাধারণ মানুষ। এরমধ্যে কোর্মা, পোলাও, বিরিয়ানি, কোফতা, ফিরনি, জর্দা, শাহী মোরগ পোলাও অন্যতম। ঢাকায় মোগলরা মাংস দিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করতো। ঢাকাইয়া কোরমায় কাঁচামরিচ দেওয়া শুরু হয় এসময়। মোগল যুগের খাবারের মধ্যে মাংসের কোফতা ছিল অন্যতম। এছাড়া তেহারি ও দোলমাও মোগল আমলে প্রচলিত খাবার। আরেকটি জনপ্রিয় খাবার ছিল কাবাব। শিক কাবাব, শামি কাবাব, মোসাল্লাম কাবাব, টিকা কাবাব, মাছের কাবাব মোগল আমলে সুখ্যাতি লাভ করে। এ সময় নানা স্বাদের পরোটাও জায়গা করে নেয় ভোজনরসিকদের মাঝে। ময়দার পুরু পরোটা, কিমা পরোটা, মোগলাই পরোটা ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। মোগলরা আসার পর রান্নায় ঘিয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পর্তুগিজরা মরিচ আমদানি করার পর খাবারে মরিচের ব্যবহারও বেড়ে যায়।
মোগল যুগের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বাকরখানি। মোগল আমলের জায়গিরদার মির্জা আগা বাকেরের নামে ঢাকার বাকরখানি রুটির নামকরণ করা হয়। তবে এ ধরনের রুটির প্রচলন করে গিয়েছিল কাশ্মিরিরা। তখন বাকরখানি তৈরিতে ঘি ও দুধ ব্যবহার করা হতো। অনেক সময় পনির দিয়েও তৈরি করা হতো বাকরখানি। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে পর্তুগিজরা পাউরুটির প্রচলন করে। সাধারণত বৃদ্ধ ও রোগীরা দুধের সাথে পাউরুটি খেতেন। পরবর্তী সময়ে ইরাকিরা ঢাকার চকবাজারে চালু করে বাগদাদি রুটি। মোগল যুগের শেষের দিকে গুজরাটিরা ঢাকায় ছাতুর প্রচলন করে। আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, কাঁটার ভয়ে তখন মাছ খেতো না অনেকে। পরবর্তী সময়ে রিঠা, রুই, চিংড়িসহ বড় কাঁটার মাছ মাংসের মসলা ও মেথি দিয়ে রান্না করে খাওয়া শুরু করে তারা। এতে দেখা গেলো রান্নার প্রক্রিয়াটা তাদের হলেও উপাদান ছিল আমাদের এখানকার। যার ফলে এই দুটো মিলে সৃষ্টি হলো নতুন এক খাদ্যরীতি।
মোগল যুগে মিষ্টান্ন ছিল ঢাকাবাসীর অত্যন্ত প্রিয়। দইয়ের সাথে দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি পাতক্ষীর কলাপাতায় পরিবেশন করা হতো। গুড়ের মন্ডা, তিলের খাজা, নাড়ু, বাতাসা, তাল মিছরি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিলো ঢাকাবাসীর কাছে। সে সময় দুগ্ধজাত মিষ্টির সুনামও ছিল বেশ। মিষ্টান্নের মধ্যে লালমোহন, ছানার সন্দেশ, কালোজাম, রস কদম, খিরসা দই জনপ্রিয় ছিল। হিন্দুগোত্রের ময়রারা মিষ্টি তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। তারা জিলাপি, ছানার সন্দেশ, রাজভোগ, রসগোল্লা, মোহনভোগ, ক্ষীরভোগ, প্রাণহরা ইত্যাদি তৈরিতে পারদর্শী ছিল। বিক্রমপুরের গাওয়া ঘি, পাটালি গুড়, ধামরাইয়ের পাতক্ষীর ঢাকায় বেশ বেচাকেনা হতো। সাভারের ‘রাজভোগ’ মিষ্টি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটমবোমা নামের এক ধরনের মিষ্টির প্রচলন শুরু হয়। বড় আকারের মিষ্টিটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া লেডিকেনি নামের মিষ্টির সুনামও ছিল বেশ। মোগল ঢাকার বরফি ও লাড্ডু আজও জনপ্রিয়।