ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

শ্যামবাজারের অতীত বর্তমান

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সবচেয়ে পুরান বাজার ঢাকার শ্যামবাজার। সারাদেশের তরিতরকারি ও কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরণ করে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে দেশের সর্ববৃহৎ এই বাজার। একসময় এটিই ছিল দেশের সবচে বড় আড়ত, বড় বাজার।

সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন জায়গায় নতুন আড়ত হয়েছে, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বাজার। কিন্তু এখনো জৌলুস ধরে রেখেছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সবচেয়ে পুরান বাজার শ্যামবাজারের আড়তগুলো।

১৭৪০ সালে ঢাকার নায়েবে নাজিম নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের সময় ফরাসি বণিকরা প্রতিষ্ঠা করেন একটি ছোট্ট ‘গঞ্জ’বা ‘বাজার’। কালক্রমে এটিই রূপান্তরিত হয় আজকের বৃহৎ শ্যামবাজারে।

একসময় ফরাসি অধ্যুষিত পুরো এলাকাটি ফরাশগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি পায়। পরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আড়তদারির উত্থানের ফলে শ্যামবাজারের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। কাঁচামাল বেচাকেনার সবচেয়ে বড় আড়ত ও বাজার শ্যামবাজারের ইতিহাস খুব চমৎকার।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখায় জানা যায়, একসময় শুধু নৌপথে বিক্রমপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, সিলেট থেকে কৃষিপণ্য আসতো শ্যামবাজার ঘাটে।

বর্তমানে খেয়ানৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার শ্যামবাজার ঘাটের জায়গা দখল করে নেয়ায় সড়কপথে ট্রাক, বাস, প্রভৃতি দিয়ে মালামাল আনা হয়। সড়কপথে শ্যামবাজারের আড়তগুলোর সঙ্গে সহজ যোগাযোগের পথ ঐতিহাসিক বাকল্যান্ড বাঁধের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশও দখলে রেখেছে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকান।

জানা যায়, রূপলাল হাউসের পুব দিকে রঘুনাথ দাস একটি বাগান গড়ে তুলেছিলেন; যা পরে সবজিবাগান হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সবজিবাগানের নাম ছিল সবজিমহল। ওই বাগানের সঙ্গেই ছিল একটি সেতু। এ সেতুটিকে বলা হতো শ্যামবাবুর পুল।

শ্যামবাবু ছিলেন ঢাকার খ্যাতনামা জমিদার ও রূপলাল দাসের ভাই সনাতন দাসের ছেলে। একপর্যায়ে বিশাল এই সবজিবাগান নষ্ট হয়ে গেলে সেখানে ধীরে ধীরে একটি বাজার বসতে শুরু করে। শ্যামবাবুর পুলের পাশে গড়ে ওঠা বাজারটিই আজকের শ্যামবাজার।

১৯৫৬ সালের দিকে এটি আনুষ্ঠানিক বাজারে পরিণত হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠিত শান্তি সমিতি নামে একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গার তীরে বাকল্যান্ড বাঁধসংলগ্ন ১৩টি আড়ত দিয়ে ৩২ জন ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের পাইকারি বেচাকেনা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালের দিকে ঢাকার সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও বড় কৃষিপণ্য বেচাকেনার আড়ত ছিল ইমামগঞ্জ আর জিঞ্জিরায়। ১৯৭১ সালের পর থেকে ইমামগঞ্জ ও জিঞ্জিরার জৌলুস কমতে থাকে।

অন্যদিকে, জমতে থাকে শ্যামবাজারের আড়তগুলো। একপর্যায়ে ইমামগঞ্জ ও জিঞ্জিরার ব্যবসায়ীরা শ্যামবাজারে চলে আসেন। এখানে গড়ে ওঠে দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি কৃষিপণ্য বেচাকেনার আড়ত। এ বাজারে অবস্থিত প্রায় ২৫০টি আড়তে মাসে ১০০ কোটি টাকার ওপরে কৃষিপণ্য বিক্রি হয়। শ্যামবাজার থেকে তরিতরকারি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, হলুদ, মরিচ, ধনেপাতা, পান-সুপারি, মালাই খয়ের, কাঁচা মরিচ, লেবু প্রভৃতি পাইকারি কেনাবেচা হয়।
সারাদেশের তরিতরকারি ও কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরন করে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে দেশের সর্ববৃহৎ এই বাজার।

তবে, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে পুরান ঢাকার শ্যামবাজার। বর্তমানে বাজারটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। বাজার সংলগ্ন রাস্তাগুলো অপ্রশস্ত। এতে এ এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। আছে আরো নানান সমস্যা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় একসময়ের খুবই জমজমাট এ শ্যামবাজার।

Scroll to Top