ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

প্রাণ-প্রকৃতি টিকে থাক একসঙ্গে

প্রকৃতি এবং প্রাণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতি ধ্বংস হলে তা প্রাণের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। প্রকৃতির একটি উপাদানও বিনষ্ট হলে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। যার প্রভাব থাকে সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতি বলতে প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানকেই বোঝায়। যার ওপর ভর করে মানবসভ্যতা এগিয়েছে। আমাদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সবকিছুর জোগান পাই প্রকৃতি থেকে। তবু প্রকৃতিকে যথেচ্ছা ব্যবহার করছি আমরা। অথচ দরকার ছিল সঠিক ব্যবহার। পরিকল্পিত ব্যবহার।

মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই উন্নয়নের বলি হিসেবে প্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের লোভ আর বিলাসিতার কারণেই প্রাকৃতিক উপাদানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। যার ফলে পৃথিবী নাম এই গ্রহ আজ হুমকিতে রয়েছে। মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, এখন প্রকৃতি তার পাল্টা আচরণ করছে। আমরা যা আশা করি না, তেমন রুদ্র রূপ দেখতে হচ্ছে। প্রকৃতি নিজেই নিজের অবস্থান পাল্টাচ্ছে; যা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে।

প্রকৃতিই যেখানে আমাদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা, সেখানে প্রকৃতিই আজ আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ইউরোপে বন্যায় এ পর্যন্ত ২০৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এরমধ্যে জার্মানিতেই মারা গেছে ১৭৩ জন। বেলজিয়ামে মারা গেছে ৩২ জন। এ ছাড়া মৌসুমি বৃষ্টির কারণে এশিয়ার দেশ চীনে অতীতের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এমন বৃষ্টিপাত আর দেখেনি। এর ফলে সেখানে প্রাণহানি ঘটেছে। কানাডায় সেদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানকার কলম্বিয়া রাজ্যের লাইটন গ্রামে এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেখানে তীব্র দাবদাহের সঙ্গে আকস্মিক বজ্রপাত থেকে দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র দাবদাহে সেখানে সাত শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ভারতের তিন রাজ্য উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থান রাজ্যে বজ্রপাতে এক দিনেই মারা গেছে ৬৮ জন।

মানবসভ্যতার টেকসই নিরাপত্তা, খাদ্য শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গাছপালা। মানুষ তার নিজের কাজের জন্য, সভ্যতার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কেটেই চলেছে। যেখানে আমাদের কোটি কোটি গাছ লাগাতে হবে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য, সেখানে আমরা সামান্য কারণেই গাছ কেটে সেখানে নির্মাণ করছি। একটি গাছ কেবল মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রকৃতির অন্যান্য বহু প্রাণীরও আবাসস্থল। পরিবেশের সবকটি উপাদান পানি, বায়ু, মাটি এবং শব্দ এসব দূষণ ঘটছে মারাত্মকভাবে। যার ফলও হাতেনাতেই পাচ্ছে মানুষ। কারণ এটা নির্ভর করছে মানুষের চরিত্রের ওপর এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই, হঠাৎ মানুষ নিজেকে বদলে ফেলবে।

বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিয়োজিত ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের (ডব্লিউডব্লিউএফ) এক বিস্তৃত প্রতিবেদনের এক তথ্যে উঠে এসেছে বিশ^জুড়ে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গেছে। গত ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এ সংখ্যা কমে গেছে। বন্যপ্রাণীর সর্বনাশা এ পতনের হার কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না এবং মানুষ যে হারে প্রকৃতি ধ্বংস করছে, তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি বলে সংস্থাটির প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। মানুষ যদি কেবল নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়; তাহলে তা হবে মানবজাতির সিদ্ধান্তে বড় ভুল। কারণ প্রকৃতির একটি উপাদান বাদ দিয়ে অন্য উপাদান চলতে পারে না। এভাবেই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।

গত ২০ বছরে বিশ্বে চরম আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এতে মানুষের পাশাপাশি অর্থনীতিরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘন ঘটনা বৃদ্ধিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য বিশ^ বসবাসের অযোগ্য নরকে পরিণত হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের মতে, আগামী এক দশকে পৃথিবীর জন্য তাপপ্রবাহ এবং খরা সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে আছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সংক্রান্ত অফিস ‘ইউএনডিআরআর’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নিতে বিশ্ব রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের ব্যর্থতায় এই গ্রহ ধীরে ধীরে কোটি কোটি মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য নরকে পরিণত হচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, শুধু ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভূমিকম্প, সুনামি এবং হারিকেনসহ বিশ্ব বড় ধরনের ৭ হাজার ৩৪৮টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ‘দ্য হিউম্যান কস্ট অব ডিজাস্টার্স ২০০৯ থেকে ২০১৯ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির এই রেকর্ড ১৯৮০-১৯৯৯ সালের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ওই সময় বিশ্ব ৪ হাজার ২১২টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছিল। জলবায়ু সেবা পরিস্থিতি ২০২০ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যা-সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

মানুষ নিজেদের আপাত টিকে থাকার জন্য, সুখে রাখার জন্য যে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড করছে তার ফলে প্রাণিকুলের অস্তিত্ব এমনকি পৃথিবীর অস্তিত্বই বিপন্ন করছে। বিশ্ব এখনো যে পথে এগিয়ে চলেছে, তাতে আগামী কয়েক দশকে এই জলবায়ুর গতি রোধ করা কঠিন হবে। কারণ মানুষ এখন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে, কিন্তু তা পুরোপুরি প্রয়োগ করা অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার রাতারাতি ব্যবহার বন্ধ করা এত সহজ কাজ নয়। এর সঙ্গে সভ্যতার উন্নয়নের চাকা জড়িয়ে আছে। তবে এটা বাস্তবায়িত হবে। এই জীবাশ্ম জ্বালানি পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশেই দায়ী। প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কোনো সংস্থার একার নয়। সেটা সম্ভবও নয়। এই দায়িত্ব আমাদের সবার। কারণ বাঁচার তাগিদ আমাদের সবার অর্থাৎ বিশ্বসভ্যতার।

Scroll to Top