লালনের সমকালীন ব্যক্তিত্বরা লালনকে নিয়ে কি ভাবতেন? লালনের চিন্তা-চেতনা কি তাঁদেরকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে? অথবা লালন ও তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিদের দর্শন ও মতবাদে কতটা মিল বা অমিল ছিল? তাদের পারস্পরিক পরিচয় বা আদান-প্রদানের সম্পর্ক ছিল কি? লালনের সঙ্গে তাঁর সময়কার কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও বৌদ্ধিক সম্পর্ক এখানে আলোচনা করা হল।
লালনের দীর্ঘ জীবন ইংরেজ শাসনের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে স্পর্শ করেছে। লালনের সময়েই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ঐ সময় ঘটেছে ওহাবী ফরায়জী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ ইত্যাদি। শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার জন্য স্থাপিত হয়েছে নানান প্রতিষ্ঠান। রামমোহনের ব্রাহ্ম ধর্মের সৃষ্টিও এই সময়ে। বাঙ্গালীর শিক্ষা-সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ধর্ম জীবনে নানা ধরনের ছোঁয়া লেগেছে এই সময়ে। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮০৭), ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), মধুসুদন (১৮২৪-১৮৭৩), রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪)-এর মতো ব্যক্তিত্বদের সমন্বয় ঘটেছিল সেই সময়ে।
নাগরিক জীবনে ঊনিশ শতকে বাংলার সামাজিক ও সাহিত্যিক পরিবেশে যখন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করছেন ঠিক তখনই অবিভক্ত বঙ্গ দেশের পল্লী অঞ্চলে লালন ফকির, পাগলা কানাই, কাঙাল হরিনাথসহ আরও কেউ কেউ প্রধানত সঙ্গীতের মাধ্যমে লৌকিক জীবনে যে বিপ্লব এনেছিলেন তার ইতিহাস অনেকটাই উপেক্ষিত।
ঊনিশ শতকের নানান কর্মকাণ্ডে বাঙ্গালীর জীবন স্পন্দিত হয়েছে। তবে এই মহাজাগরণের কর্মকাণ্ড ছিল কোলকাতা-কেন্দ্রিক বা মহানগর-কেন্দ্রিক। এই কর্মকাণ্ড সমগ্র বঙ্গ দেশে ছড়িয়ে পড়তে অনেক সময় লাগে। অপর দিকে লালন ছিলেন গ্রামের মানুষ। আলোকিত হওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সুযোগও তাঁর ছিল না। শহরের শিক্ষিত জনগণ লালনের কর্মকাণ্ড ও সাধনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো না। তারপরও লালনের সাধনা, সঙ্গীত, দর্শন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ময়কর জাগরণের জোয়ার তুলেছিল। আর এই জোয়ার রাজা রামমোহনের সমাজ জাগরণের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
লালন ফকির ও অন্যান্য বাউলের গান গ্রাম-বাংলায় একদিকে যেমন লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনি অন্যদিকে কোলকাতা-ঢাকাসহ অনেক শহরাঞ্চলে মরমী বাউল-ফকিরদের ব্যাপক যাতায়াত এবং সমকালে ব্রহ্ম-গীতি ও নীতি কবিতা প্রচলনের ফলে খুব সহজে শিক্ষিত সমাজ বাউল ও মরমী গানের প্রতি কৌতুহলী হন। শহর-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিকরা যখন লালনের দর্শনকে পেলেন তখন অনেকেই অবাক হয়ে তাঁদের নগর-কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা বন্ধ করেছেন। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে দলে দলে তখনকার সমাজের অনেক শিক্ষিত মানুষও লালনের মানবতত্ত্বের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সমকালীন চিন্তায় তাই লালন বাঙ্গালীর মানসপটে এক ব্যাতিক্রমী আবির্ভাব।
রবীন্দ্রনাথই লালনচর্চার পথিকৃৎ এবং তিনিই প্রথম সমাজে লালনকে পরিচয় করিয়ে দেন- বিদগ্ধ সমাজে এমন একটি জনশ্র“তি আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে থেকেই লালন প্রচার ও চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের আগে যাঁরা লালনচর্চা করেন তাঁদের মধ্যে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, জলধর সেন, অক্ষরকুমার মৈত্রেয়, উকীল রাইচরণ দাস, সরলা দেবী, মৌলভী আবদুল ওয়ালী, দুর্গাদাস লাহিড়ী, অনাথকৃষ্ণ দেব, কুমুদনাথ মল্লিক, মীর মশাররফ হোসেন, করুণাময় গোস্বামী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
লালন ও কাঙাল হরিনাথ
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১২৪০-১৩০৩ বঙ্গাব্দ, ১৮৩৩-১৮৯৬ খৃস্টাব্দ) ছিলেন নির্ভীক সংবাদপত্রসেবী, সাহিত্যিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একজন অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের কিছুটা সুযোগ পেয়েছিলেন যা লালন ও অন্যরা পান নি। গদ্য-পদ্যসহ প্রায় ৪০টি গ্রন্থ রচনা এবং ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩-৮৫)’ সাময়িকী পরিচালনার কারণে তিনি সুধী সমাজে একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। এরপর বাউল দল গঠন এবং গান রচনা করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে সংযোজন করলেন আরেকটি অধ্যায়। অবশ্য হরিনাথের ব্যক্তিগত পরিচিতির কারণে সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি এই ধারা প্রসারিত হয় পল্লীর জনপদ হতে নাগরিক জীবন পর্যন্ত।
রবীন্দ্রনাথই প্রথম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লালনকে পরিচিত করে তুললেও কাঙাল হরিনাথই প্রথম লালনকে জনসম্মুখে নিয়ে আসেন। কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগেই লালন ফকিরের পরিচিতিমূলক আলোচনা মুদ্রণ আকারে রচনা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘গ্রামবার্ত্তা’তে। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় ‘জাতি’ শীর্ষক একটি সংবাদ নিবন্ধে লালন ফকিরের উল্লেখ পাওয়া যায় এভাবে- “…. লালনশা নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। ইহারা যে জাতিভেদ স্বীকার করে না সে কথা বলা বাহুল্য। এখন পাঠকগণ চিন্তা করিয়া দেখুন, এদিকে ব্রাহ্মধর্ম্ম জাতির পশ্চাতে খোঁচা মারিতেছে, ওদিকে গৌরবাদীরা তাহাতে আঘাত করিতেছে, আবার সে দিকে লালন সম্প্রদায়িরা, ইহার পরেও স্বেচ্ছাচারের তাড়না আছে। এখন জাতি তিষ্ঠিতে না পারিয়া, বাঘিনীর ন্যায় পলায়ন করিবার পথ দেখিতেছে (১০ম ভাগ ১৭ সংখ্যা ঃ ভাদ্র ১ম সপ্তাহ, ১২৭৯ ঃ আগস্ট ১৮৭২; পৃঃ ৩)।”
তবে মরমী কবি লালন ফকির ও কাঙাল হরিনাথের মধ্যে একসময় গড়ে উঠেছিল গভীর সখ্যতা এবং হৃদ্যতা। এই হৃদ্যতার মূলে ছিল সমভাবাপন্নতা – উভয়ে মানুষের মাঝেই ঈশ্বর-সন্ধান করেছেন। ললিনের মতো কাঙাল হরিনাথের ধর্মচিন্তা, ধর্মাচরণ, ধর্মদৃষ্টি বা ধর্মবোধও কোনো পরিচিত প্রথাগত আশ্রয়ে স্বস্তির সন্ধান করে নি, বরং ধর্মবোধেও জাগ্রত থেকেছে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী। মানুষের জন্য চিন্তা, মানুষের মঙ্গল কামনা তাঁদেরকে উভয়কেই মানবিকবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
এঁরা একে অন্যের আখড়ায় যেতেন। কুমারখালীতে হরিনাথের বাসস্থান থেকে লালনের সাধনপীঠ ছেঁউড়িয়ার দূরত্ব মাত্র ১০/১২ কি.মি.। কাঙাল কুটিরে বর্ষীয়ান সাধক লালনের যাতায়াত সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্বস্ত বিবরণ পাওয়া যায়। জলধর সেন তাঁর ‘কাঙ্গাল হরিনাথ’ (১ম খণ্ড ঃ ১৩২০ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থে লালন ফকিরের প্রেরণাসঞ্চারী ভূমিকার উল্লেখসহ একটি গান উদ্ধৃত করেন। ১৮৮০ সালে কাঙাল হরিনাথের ‘ফিকিরচাঁদের বাউল দল’ গঠিত হয় লালনের প্রভাবেই। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জলধর সেনের রচনা থেকে জানা যায়, ১৮৮০ সালে (১২৮৭ বঙ্গাব্দ) গ্রীষ্মের এক সকালে লালন কাঙাল কুটিরে এসে শুনিয়েছিলেন কয়েকটি গান।
সেখানে কাঙাল হরিনাথসহ জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং ‘গ্রামবার্ত্তা’ সাময়িকীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। ঐদিন দুপুর বেলায় ‘গ্রামবার্ত্তা’র কার্যালয়ে হরিনাথের অনুপস্থিতিতে একটি বাউল দল গঠনের প্রস্তাব দেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, যিনি পরে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পরিচিতি পান। তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হলে তখনই রচিত হয় একটি গান (কিংবদন্তীর কাঙাল হরিনাথ স্মারকগ্রন্থ, শিলাহদহ রবীন্দ্র সংসদ, শিলাইদহ, কুষ্টিয়া, এপ্রিল ২০০৫)।
কাঙাল হরিনাথ তাঁর বাউল দল নিয়ে প্রথমে কুমারখালী এবং পরে সফর করেন অবিভক্ত বঙ্গ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দলের প্রধান গান রচয়িতা কাঙাল হরিনাথ হলেও দলের অন্য এক শিষ্য কথাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন দলের প্রভাবে বেশ কিছু গান লেখেন (কিংবদন্তীর কাঙাল হরিনাথ স্মারকগ্রন্থ, শিলাহদহ রবীন্দ্র সংসদ, শিলাইদহ, কুষ্টিয়া, এপ্রিল ২০০৫)। পরে ‘সঙ্গীত লহরী (১৮৮৭)’ নামে মীর মশাররফের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের একটি গানে লালনের উল্লেখ আছে।
তবে এর আগে তাঁর ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’ (১ম ভাগ ১ম সংখ্যা ঃ ১২৯২ বঙ্গাব্দ, ১৮৮৫ খৃস্টাব্দ) গ্রন্থে কাঙাল হরিনাথ লালনের একটি গান সংগ্রহ করে মুদ্রণ করেন এবং এই গানটির সুরে বাঁধা তাঁর কয়েকটি গানের উল্লেখ করেন। এটিই লালনের গানের প্রথম মুদ্রণ বলে ধারণা করা হয়।
কাঙাল হরিনাথের বিপদের দিনেও লালন ছিলেন তাঁর একান্ত আপনজন। লালনের শিষ্যসামন্তরা হরিনাথের জীবন রক্ষায় অন্যতম প্রহরী ছিলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলে প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে তথ্যমূলক প্রামাণ্য সংবাদ প্রকাশের কারণে শিলাইদহের জমিদারের আমলারা হরিনাথের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াসহ তাঁকে নানাভাবে হেনস্তা করতে থাকেন। প্রথমে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে বশ মানানোর চেষ্টা চলে। এতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে একাধিকবার হত্যারও চেষ্টা করা হয়। একদিন রাতে হরিনাথের বাড়ি আক্রান্ত হয়। সেদিন লালন ফকির স্বয়ং লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে শিষ্যভক্তদের নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করে হরিনাথকে বাঁচিয়েছিলেন। কাঙাল হরিনাথ তাঁর অপ্রকাশিত ‘দিনলিপি’তে কৃতজ্ঞচিত্তে সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
লালন ও রাজা রামমোহন
ঊনিশ শতকের যুগ প্রবর্তক মনীষী মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) সমসাময়িক ছিলেন লালন। এঁদের একজন ছিলেন আধুনিক, আর অন্যজন গ্রাম্য সমাজের বাসিন্দা। কিন্তু দু’জনই সমাজ সংস্কারক। একজন মানুষের ভেতরের মানবতত্ত্বে বিশ্বাসী, অপরজন মানবতত্ত্ব ও তৎকালীন হিন্দু সমাজের, বিশেষ করে সনাতন হিন্দু সমাজের নানান কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। রামমোহন পাশ্চাত্য চিন্তাকে কাজে লাগিয়েছেন, আর লালন বাঙালীর চিরায়ত লোকসংস্কৃতিকে কাজে লাগিয়েছেন।
ঊনিশ শতকে বাঙালীর নবজাগরণে লালনের ভূমিকার কথা জানা যায় সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাধক কবি লালন ও নবজাগরণ’ (উত্তরবঙ্গ পত্রিকা, কলিকাতা, ১৯৮৮) প্রবন্ধে। এছাড়া অধ্যাপক মুহম্মদ আবূ তালিব তাঁর ‘লালন শাহ ও তৎকালীন বাঙালী সমাজ’ (ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক সম্পাদিত লালন মৃত্যু-শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ ১৯৯২) নিবন্ধে রামমোহন ও লালনের রচনার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।
উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং ধর্মের সমন্বয়ের শুভ্র চেষ্টায় ‘ভারত পথিক’ ও বাঙ্গলার নবজাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে রাজা রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩) সম্মানিত। রামমোহন ১৮১৪ সালে কোলকাতায় আসেন। এখানে তিনি সমাজ বিপ্লবের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন, বাঙালীর নবজাগরণের শুভ সূচনা হল তাঁর হাতে। এর আগেই তিনি পাটনায় অধ্যয়ন করেছেন আরবি ও ফারসি, কাশীতে সংস্কৃত। বৌদ্ধ ধর্মের অন্তরস্বরূপ বুঝতে ভ্রমণ করেছেন তিব্বত। ইংরেজদের অধীনে চাকরি করে ইংরেজি ভাষাতেও বুৎপত্তি অর্জন করেন। এসব কিছুই তাঁকে যুক্তিগ্রাহ্য, পৌত্তলিকতাবিরোধী একেশ্বরবাদী ধর্মমতে বিশ্বাসী হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। কাঙাল হরিনাথও রামমোহন প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রামমোহনকে তিনি ‘ভগবানের বিশেষ শক্তিলাভ’কারী (‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’, ৪র্থ ভাগ ঃ ১২৯২) বলে মনে করতেন।
লালন ও রামমোহনের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ড. তুষার চট্টোপাধ্যায়, যিনি লালনের প্রকৃত প্রতিকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রমাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা রেখাচিত্রটিই লালনের পার্থিব দেহের একমাত্র ছায়া, এমন একটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। “সমকালীন অন্যতম সাধক কবি লালশশী (রাম দুলাল চন্দ্র) প্রতিষ্ঠিত ঘোষপারার (নদীয়া জিলার) কর্তাভজা মেলায় রামমোহনের যাতায়াত ছিল। এই মেলা-সূত্রে লালন-রামমোহনের সাক্ষাৎকার সংঘটিত হওয়া সম্ভব। কেননা লালনেরও এখানে যাতায়াত ছিল (লালন শাহ ও তৎকালীন বাঙ্গালী সমাজ, অধ্যাপক মুহম্মদ আবূ তালিব, লালন শাহ মৃত্যু-শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ১৯৯২, পৃ. ২১)”।
রামমোহন ও লালনের একেশ্বরবাদী মানব ধর্মের মধ্যে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রামমোহন বাঙালী নবজাগরণের বাণী ফারসি ভাষায় রচিত তাঁর ‘তুহফাৎউল মুওয়াহিদ্দীন (১৯০৪)’ বা ‘একেশ্বর বিশ্বাসীদের প্রতি উপহার’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। এর বিষয়বস্তু এবং রামমোহনের চিন্তাধারা, এমনকি বর্ণনাভঙ্গীরও সাযুজ্য রয়েছে লালনের চিন্তাধারার সঙ্গে। এই গ্রন্থটির পাশাপাশি লালনগীতি ও লালনের জীবন দর্শনের পরিচিতিমূলক গ্রন্থগুলো রেখে বিচার করলে দেখা যাবে বিপরীত পরিবেশে বেড়ে উঠলেও একই যুগ-পথিকের চিন্তাধারার কি আশ্চর্য মিল! রামমোহন পাশ্চাত্য শিক্ষা-সভ্যতার অনুরাগী হয়েও প্রাচ্য সুফী সাহিত্যের, বিশেষ করে হাফিজ-সাদীর কাব্যের একজন ভক্ত ছিলেন।
হাফিজ, সাদী, রুমী প্রমুখ সুফী সাধকের রচনার সঙ্গে লালনেরও রচিত সঙ্গীতগুলোর অনেক মিল পাওয়া যায়। তাই লালনের সঙ্গীত ও দর্শনের সঙ্গে রামমোহনের চিন্তাধারার মিল থাকা স্বাভাবিক। উভয়ের রচনার মধ্যে বাহ্যত কিছু পার্থক্য থাকলেও অন্তর্নিহিত গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। দুই পরিবেশের দুই মহাত্মার এই অন্তঃমিলটা আমাদের অবাক করে বৈকি।
লালন ও শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব
কুমারখালীর প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব (১৮৬০-১৯১৩) ছিলেন একজন মুক্তমনের মানুষ। তিনি ছিলেন ‘শৈবী’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর লিখিত গ্রন্থ চণ্ডীতত্ত্ব, রাসলীলা, গীতাঞ্জলি (শাক্তসঙ্গীত সংকলন), সন্দেশ (নাটক), তন্ত্রতত্ত্ব, কর্তা ও মন, স্বভাব ও অভাব, মা, দুর্গোৎসব প্রভৃতি। একান্তভাবে তান্ত্রিক সাধক হলেও তাঁর মধ্যে সাধনমার্গ সম্বন্ধে উদার ও সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় মেলে। বিদ্যার্ণব রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজের একজন হলেও হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান ধর্মের অগণিত সাধারণ মানুষ ছিলেন তাঁর অনুরক্ত। অনেকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশিও ছিলেন।
বিদ্যার্ণব তাঁর কুমারখালীর বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর আরাধ্য সর্বমঙ্গলা দেবীর বিগ্রহ ও মন্দির, ব্যবস্থা করেন নিত্যসেবা পূজার। ‘সর্বমঙ্গলা’ শব্দটির অর্থ সবার মঙ্গলের জন্য যে মাতৃশক্তির অধিষ্ঠান। শুধু লালন ও হরিনাথই নন, শিবচন্দ্রের অনুরক্ত ছিলেন জলধর সেন, মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রমুখ। বিদ্যার্ণবের বাবা ছিলেন হরিনাথের মন্ত্রদাতা দীক্ষাগুরু। সেই সূত্রে বয়সে ছোট হলেও বিদ্যার্ণবের সঙ্গে হরিনাথের ঘণিষ্ঠতা ছিল। লালন ও হরিনাথ উভয়ই একসময় বিদ্যার্ণবের মন্দিরে আসতেন বলে জানা যায় হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৫-১৯৮৫) লেখায় (লালন ফকির, লালন স্মরণিকা, নদীয়া, ১৯৭৬)। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “… এই সূত্রে এঁদের তিন জনের মধ্যে গভীর সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। মনে হয়, শিবচন্দ্রের চিন্তায় শাক্ত বৈষ্ণব ও বাউলের দৃষ্টিভঙ্গির যেন একটি সমন্বয় ঘটেছিল, তাঁর রচিত সঙ্গীতেও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত দেখা যায়।”
লালন ও বিদ্যার্ণব উভয়েরই প্রথম জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল (১৮৯৫-১৯৭৫) ‘তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব’ গ্রন্থে লিখেছেন (কিংবদন্তীর কাঙাল হরিনাথ স্মারকগ্রন্থ, শিলাইদহ রবীন্দ্র সংসদ, শিলাইদহ, কুষ্টিয়া, এপ্রিল ২০০৫)-
“আমাদের দেশে মহাত্মা লালন ফকির সাধকরূপে সর্বসাধারণের মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন, কাঙাল হরিনাথের গ্রামের আখড়ায় তাঁহার সহিত বিদ্যার্ণবের প্রথম আলাপ আলোচনা হয়। ইহার পর উভয়ের সহিত অনেকবার ভাবের আদান প্রদান হয়। ইহার বিশদ বিবরণ অধুনা দুষ্পাপ্য। বয়সে জ্যেষ্ঠ হইলেও ফকির বিদ্যার্ণবকে দাদাঠাকুর বলিয়াই সম্বোধন করিতেন। একদিন ফকির মায়ের বাড়ি কুমারখালী আসিয়া সমবেত হইলেন। মায়ের দুলাল তাঁহাকে পরম আদরে বসিতে দিলেন। কুশল প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসাবাদ অন্তে গান গাইবার জন্য ফকিরকে অনুরোধ করিলেন, ফকির স্বভাবসুলভ সরলতা ভরে গাইলেন – ‘আমি একদিনও না দেখলাম তারে/আমার বাড়ির কাছে আরশীনগর… পরশী বসত করে…।’ মায়ের দুলাল নিবিষ্টচিত্তে সঙ্গীতটি শ্রবণ করিলেন… উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিলেন… কি অপূর্ব সঙ্গীত! ইহার পর হৃষ্টমনে ফকিরকে নিকটে বসাইয়া যথেষ্ট সমাদর করিলেন এবং কুমারখালী আসিলেই ফকির যেন মায়ের বাড়ি সাক্ষাৎ দেন বলিয়া অনুরোধ করিলেন। বলাবাহুল্য, ফকির এই অনুরোধ রক্ষা করিয়া চলিতেন।”
এই গ্রন্থের আরেক জায়গায় আছে, “… লালন ফকির শাহ্ আজ যাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার উদ্দেশ্যে যাওয়া মনস্থ করিয়াছেন, তাঁহার নিকট হইতে আর কতটা প্রত্যাশা করিতে পারেন?… এইরূপ মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে অবশেষে তিনি পণ্ডিত শিবচন্দ্রের বহির্বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়া পণ্ডিত বিদ্যার্ণবের সহিত সাক্ষাৎকারের ইচ্ছা প্রকাশপূর্বক ভিতর বাড়িতে খবর পাঠান। বিদ্যার্ণব মহাশয় সংবাদপ্রাপ্ত হইয়া লালনের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বহির্বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলে মহাত্মা লালন যুক্তপানি হইয়া সমভ্রম প্রদর্শনপূর্বক সম্মুখে অগ্রসর হইতে থাকিলে বিদ্যার্ণব মহাশয়ও এতদ্দর্শনে অগ্রসর হইয়া আসিয়া লালন ফকির সাহেবের যুক্তকরযুগল স্বীয় হস্তদ্বয় মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া নিজের বুকের মধ্যে স্থাপন করিলেন। ফকির লালন ব্রাহ্মণ বিদ্যার্ণবের নিকট এবম্বিধ মহান উদার অন্তঃকরণের সাগ্রহ সাদর সম্ভাষণ ও ব্যবহার আশা করেন নাই। – পণ্ডিতপ্রবর শিবচন্দ্র… ভাবোদ্বেলিত মহাত্মা লালনের মস্তক নিজের বুকে চাপিয়া ধরিয়া সাশ্র“নয়নে ঐখানেই দণ্ডায়মান হইয়া পড়েন। আহা! সে কী এক অপূর্ব সুন্দর অপার্থিব দৃশ্য। ভেদজ্ঞান রহিত অভেদ জ্ঞানের মূর্ত বিগ্রহ। কিয়ৎক্ষণ পরে ভাবাবিষ্ট লালন ফকির পণ্ডিত বিদ্যার্ণব মহাশয়ের বুকের উপর শায়িতশিরে স্বরচিত গান… গাহিতে আরম্ভ করেন – সবে বলে লালন ফকির/ হিন্দু কি যবান/ লালন বলে আমার আমি/ না জানি সন্ধান…। …. চারিদিক হইতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের বহুলোক সমবেত হইয়াছেন এই মহামিলন ও মহাভাব সমন্বয় সন্দর্শনে। গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজের কোন কোন পণ্ডিত স্পর্শ দোষাদির কথা উল্লেখপূর্বক প্রসঙ্গ উত্থাপন ও শাস্ত্র রচনাদির অবতারণা করিলে পণ্ডিত শিবচন্দ্রও বিভিন্ন শাস্ত্রাদি হইতে শ্লোক উদ্ধৃতির দ্বারা মতামত আলোচনাপূর্বক যুক্তিপূর্ণ প্রাঞ্জল ব্যাখ্যান দ্বারা দেখাইয়া দেন যে ধর্মের মূলতত্ত্ব ধর্মীয় সংকীর্ণতা, আনুষ্ঠানিক সংস্কারের অনেক ঊর্ধ্বে। মানুষে মানুষে অভিন্নতা অনুভব ও উপলব্ধি, সমদৃষ্টি, সর্বজনীন ও সর্বকালীন ঈশ্বরবোধ, সকল জাতি ধর্ম এবং সম্প্রদায়গত গণ্ঢীর ঊর্ধ্বে বিশ্বমানবিকতাবোধ। আরও দেখাইয়া দেন প্রকৃত জীবন দর্শন জীবনকেন্দ্রিক মানবতাবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইহাতে সংকীর্ণতা ও ভেদবুদ্ধির কোন স্থান নাই। ধর্মীয় একই পরমবস্তুকে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন অভিধায় প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন তত্ত্বদর্শী সাধকগণ – একই বস্তুকে তাঁহারা স্ব-স্ব দেশের মানুষের ভাষায় প্রকাশ করিয়াছেন মাত্র।… পণ্ডিত শিবচন্দ্রের এই ধর্মোপলব্ধি ও ধর্মবোধ এবং বিশ্বমানবিকতাবোধ লালনের হৃদয়কে খুবই আকৃষ্ট ও অভিভুত করে। পণ্ডিত শিবচন্দ্রও লালনের উদার ধর্মসঙ্গীত শুনিয়া পরম প্রীতি ও আহ্লাদিত হইয়া লালনকে এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেন যে, তিনি যখসই এতদঞ্চলে আসিবেন তখন যেন তিনি সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে আসিয়া তাঁহার গান শোনাইয়া মায়ের প্রসাদ পাইয়া তবে যান। অতঃপর মহাত্মা লালনও প্রদত্ত প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী যখনই কুমারখালী প্রভৃতি অঞ্চলে আসিতেন, তখনই সর্বমঙ্গলা মায়ের মন্দিরে গান শোনাইয়া এবং মায়ের প্রসাদ পাইয়া তাঁহার প্রতিশ্র“তি পালন করিয়া গিয়াছেন।”
লালন ও বিদ্যার্ণব উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অভিন্ন- সমস্ত মানুষ এক, কেউ আলাদা নয়। তাঁর ভজন-সাধন ছিল মানুষকে কেন্দ্র করেই। হানাহানি আর সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে লালনের গানের বাণী ও সুর মানুষে মানুষে মিলনের সেতু – সম্প্রীতির বন্ধন রচনা করেছে। লালন ইহ ও দেহতে বিশ্বাস করতেন। ইহলোক অর্থে মানুষের জীবিতকাল, এই জন্ম এই সংসার এই স্থান আর এই কাল। লালন শাস্ত্রাচারের মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন না। অথচ ব্রাহ্মণ বিদ্যার্ণবের সঙ্গে সখ্যতায় সেটা কোনো বাধার সৃষ্টি করে নি।
লালন ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে জমিদারী পরিচালনা করতে এসে বাউল ফকির বৈধবদের সংস্পর্শে আসেন। সেখানে লালনের গানের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে বলে ধারণা করা হয়, যদিও এই দু’জনের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে গবেষক-সমালোকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে তাঁর ‘ছিন্নপত্র’র একটি চিঠির অংশবিশেষ। এটি এটাও প্রমাণ করে যে লালনের পার্থিব দেহের একমাত্র প্রতিকৃতিটি রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছিলেন। এ প্রসঙ্গে লালন গবেষক মুহম্মদ আবূ তালিবের মন্তব্য হলো, “এরূপ অনুমান করতে দোষ নেই, লালনের অন্তিমকালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন এই ছবি আঁকেন, তখন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকতেও পারেন। অন্তত তাঁর ছিন্নপত্রের একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ঐ বছরের শেষভাগে তিনি মাসাবধি শিলাইদহে সপরিবারে কাটান। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও প্রায় সমসময়েই শিলাইদহে বোটে বসেই লালনের প্রতিকৃতি আঁকেন (২৩ বৈশাখ, ১২৯৬/ মে ৫, ১৯৯৮ খ্রীঃ)। আনন্দবাজার ও অন্যান্য পত্রিকায় এই প্রতিকৃতি প্রকাশিত হয়েছে (লালন শাহ ও তৎকালীন বাঙ্গালী সমাজ, অধ্যাপক মুহম্মদ আবূ তালিব, লালন শাহ মৃত্যু-শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ১৯৯২, পৃ. ২৯)।”
অধ্যাপক তালিব আরও লিখেছেন, “অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ লালনের কতটা সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন বলা না গেলেও কৈশোর ও (যৌবনের) সন্ধিক্ষণে তিনি যে বেশ কিছুকাল লালনের সান্নিধ্য লাভে সমর্থ হয়েছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। আর বিশেষ করে সঙ্গীত-পাগল রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে যে লালনের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং সেই মনোরম গ্রাম্য পরিবেশে লালনশাহী ফকীর-সমাজের একতারা তাঁর কবি-মানসকে কিভাবে সংগঠিত করে তুলেছিল, আর তিনি একর পর এক করে অপূর্ব কাব্য ফসলে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন এবং কিভাবে তাঁর মানসলোকে সঙ্গীত সুধার পলি জমে ধীরে ধীরে ‘জীবন দেবতা’র চর জেগে উঠেছিল, রবীন্দ্র-সাহিত্য সমালোচকদের কাছে তা নিতান্তই আকর্ষণীয় মনে হবে নিশ্চয়ই।”
রবীন্দ্রনাথ লালনকে উপনিষদের ঋষির সঙ্গে তুলনা করেছেন। লালন রবীন্দ্রনাথকে সম্মোহিত করেছিলেন। তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে, নাটকে, গানে লালনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের মানসের যে চিন্তা, এক পর্যায়ে লালনের সাক্ষাতে তা আরও দৃঢ় হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই দায়িত্ব মনে করে লালনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লালনকে তুলে ধরেছেন।
অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথ লালনের গানের মর্মবাণী ও তাঁর দর্শনকে গ্রহণ করতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি। বরং তাঁর লেখা অনেক গানেই লালনের দর্শনকে অবলীলায় ব্যবহার করেছেন। ভিন্ন সময়ে ও ভিন্ন স্থানে বেড়ে উঠলেও মানসে তাঁরা এক ও অভিন্ন সত্তায় মিলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব দেবতা, জীবন দেবতার অনুভূতির মূলে রয়েছে লালনের সেই ‘মনের মানুষ’র অনুভূতি। এটি তাঁর পূর্বসূরী লালনের মানুষ তত্ত্বেরই আর এক রূপ।
‘সবে বলে লালন ফকির/ হিন্দু কি যবান
লালন বলে আমার আমি/ না জানি সন্ধান’
‘আমার দোসর যে জন ওগো/ তার কে জানে
একতারা তার দেয় কি সারা/ আমার গানে কে জানে’
– রবীন্দ্রনাথ
বাংলা সাহিত্যে, বাংলা কবিতায় ব্যক্তিক কবিতা যেমন সবচেয়ে সফল রবীন্দ্রনাথের কাব্যে, লালনের গানে তেমনি বাউল সাধনা চরম অভিব্যক্তি লাভ করেছে। লালন বৈষ্ণবীয় দ্বৈতবাদ, সুফী মরমীয়া সব পথ অবলম্বন করে তাঁর হৃদয়ের ধর্মকে আত্মতত্ত্ব রূপে প্রকাশ করেছেন। বাউল বা লালনের মতো রবীন্দ্রনাথও বাইরের ধর্মের চেয়ে ভেতরের ধর্মকেই পরম ধর্ম মনে করতেন। তিনি বলেছেন, “আমার ধর্ম কি তা যে আমি আজও সম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট করে জানি, এমন কথা বলতে পারি নে। অনুশাসন আকারে তত্ত্ব আকারে কোন পুঁথিতে লেখা ধর্ম সে তো নয়।” তার অর্থ তাঁর ধর্ম তাঁর হৃদয়ের ধর্ম, তাঁর আত্মতত্ত্ব ধর্ম। প্রখ্যাত লালন গবেষকদের অনেকেই এই বিষয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। যেমন, আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর ‘দুই বাউল ঃ রবীন্দ্রনাথ ও লালন’ (লালন মৃত্যু শতবর্ষ স্মারকপত্র, ১৯৯০) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাব-জগতে লালনের প্রভাব দৃষ্টান্তসহ আলোচনা করে দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে কোথায় লালন দর্শন ও রবীন্দ্র দর্শন একাকার হয়ে গেছে।
অখ্যাত গ্রাম্য নিরক্ষর লালনের সমাজ চিন্তা, মানবপ্রেম ও মনুষ্যত্ববোধের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা তাঁর সমকালীন শিক্ষিত শ্রেণীভুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিন্তাধারার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, আজও নয়। বরং, ঐতিহাসিকভাবে লালনের গুরুত্ব যেকোনো সমাজ সংস্কারক এবং সাধকের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ লালনের সেই পরিচয় উপেক্ষিত ও অলিখিত। বাঙ্গালীর সংস্কৃতিচর্চায় লালনকে যেভাবে আনা উচিত ছিল সেভাবে আনা হয় নি। হাতে গোনা ক’জন কেবল লালনকে নিয়ে চর্চা করেছেন। কিন্তু যেভাবে লালনকে ধারণ করা উচিত তা সম্ভব হয় নি। লালনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদ, কুসংস্কার ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে যে আহ্বান তা আজও সমাজে গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাই লালনকে চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনিল সেন, সালমা রহমান