ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা’

ঋতু পাল্টে আসে আষাঢ় মাস। আষাঢ়ের প্রথম দিবসে মেঘের আগমনে প্রকৃতির নিয়মেই মন হয়ে ওঠে আকুল। প্রাণ সঞ্চার হয় গ্রীস্মের খরতাপে পুড়ে যাওয়া ধরণীতে। আর তখনই মনে হয় মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যে নববধুঁ প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে কৈলাসে পাঠানো যক্ষের ‘বিরহবারতা’র কাহিনী।

যক্ষের বিরহবারতা মেঘদূত যুগ হতে যুগান্তরে সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহকাতর চিত্তে। তাই কালিদাসের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-

কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত প্রদোষে, বরষে

কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

লিখেছিলে মেঘদূত।’ মেঘমন্ত্র শ্লোক

বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

রাখিয়াছে আপন আধার স্তরে স্তরে

সঘন সংগীত মাঝে পুঞ্জীভূত করে।

বৃষ্টির শব্দে বাঙালির হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে যক্ষের মতোই। তখন বিরহী হৃদয়ে কেতকীর মনমাতানো সুগন্ধ ও কদমফুলের চোখ জুড়ানো শোভা হয়ে ওঠে অনুষঙ্গ।

আজ মহাকবি কালীদাসের সেই ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’, বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন। তৃষিত হৃদয়, পুষ্প-বৃক্ষ, পত্র-পল্লবে নব প্রাণ সঞ্চারিতে আজি এ বরষা সমাগত। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে ফেটে চৌচির মাটি। কাঠফাঁটা রোদে পিপাসায় পথিকের ছাতি কাঁপে দুদ্দুর। ঠিক সেই সময় স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসে আষাঢ়। রসসিক্ত হয়ে ওঠে প্রকৃতি, উর্বর মাটিতে জন্মে বৃক্ষ। সবুজ হয়ে ওঠে বসুন্ধরা।

আর রিনি-ঝিনি বৃষ্টির শব্দ সেই যক্ষের মতোই উতলা করে হৃদয়। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে অন্ধকার চারদিক, প্রাণে সঞ্চার করে ভয়। আর সেই বজ্র-বৃষ্টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।

তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা

তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে…

মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।

ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আষাঢ়ের। সময়-অসময়ে ঝমঝম বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, খাল-বিলে থৈ থৈ পানি, নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পাল তোলা নৌকার সারি। বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মনও যেন নেচে ওঠে।

প্রকৃতি রূপ-রঙে হয়ে ওঠে ঢলঢল। ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক, চারিধারে অথৈ থৈ থৈ পানি, আবহমান বাংলার রূপ হয় অপরূপ যেনো ‘রূপবতী সলিল দুহিতা’।

আষাঢ়ের আশীর্বাদে প্রকৃতি ভরে ওঠে ফুলে ও ফসলে। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল, তমাল, শাল, পিয়াল আর মরাল কপোতের বনবীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ নাম না জানা অসংখ্য ফুল।

বর্ষা নিয়ে যুগে যুগে অসংখ্য কবিতা-গল্প-গান লিখেছেন কবি-সাহিত্যিকরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আষাঢ় কবিতায় বলেছেন, ‘বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল…’ সেই আবেগময় প্রেমান্ধতার বহিঃপ্রকাশ। অথবা দাবদাহ থেকে রক্ষায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চাহে আষাঢ়ের আশিষ বাণী’ গান মোহ সৃষ্টি করে হৃদয়ে।

বর্ষাকে বাদ দিয়ে ঋতু রূপ অচিন্তনীয়। কবিতায়, সুরে-গানে, তুলির আঁচড়ে কিংবা গ্রামীণ বধুঁর সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে নকশীকাঁথায় বর্ষার অপরূপ বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা যেন এরই প্রমাণ বহন করে।

কিন্তু নগর জীবনে আষাঢ়ের বৃষ্টি আশীর্বাদ নয়, বয়ে আনে দুর্ভোগ। সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। আর ভারী বৃষ্টিতে নর্দমার নোংরা পানির সাথে একাকার হয়ে যায় বৃষ্টির পানি। অসম্ভব হয়ে পড়ে চলাচল। আর বছরের চাকা ঘুরেলেই নগরবাসীদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তখন তাদের মনে হয় আষাঢ় নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি ঘোর মিছে।

Scroll to Top