ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

কালাইয়া বন্দর : গরু-মহিষের বিশাল হাট

প্রাচীন বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে চন্দ্রদ্বীপ নামে এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজধানী ছিল এখনকার পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কচুয়া। বৃটিশ, পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি কিংবা বার্মিজ নাবিকরা তাদের জাহাজ ভেড়াতো চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও এখান থেকে সুপেয় মিঠা পানি সংগ্রহ করতো তারা।

বিদেশি জাহাজের নিত্য আনাগোনা। রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত চন্দ্রদ্বীপের রাজা ‘কালাই’। তিনি রাজ্যের দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত খালের পাড়ে তৈরি করেন ঘাট, যেখানে দেশী-বিদেশী সাম্পান, নৌকা, ছোটবড় জাহাজ ভিড়তো।

ক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে এলাকায়। গড়ে ওঠে বাজার। রাজার নামে নাম রাখা হয় কালাইয়া বাজার, যা এখন কালাইয়া বন্দর নামে পরিচিত। সে হিসেবে কালাইয়া বন্দরের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। এর কতোটা ইতিহাসের তথ্য, আর কতোটা জনশ্রুতি তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

দক্ষিণাঞ্চলে সবচেয়ে বড় ও ঐহিত্যবাহী হাট এটি। সপ্তাহে প্রতি সোমবার কালাইয়া বন্দরে হাট বসে। সারিসারি দোকানপাট, ব্যস্ত লোকজন। এমনিতে দেশের অন্য যেকোনো হাটের মতোই কালাইয়া। আলাদা হলো, কালাইয়া বন্দরের গরু-মহিষের হাট। গরু-মহিষের এতোবড় হাট এ অঞ্চলে আর নেই।

দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর দশমিনা, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, চরকাজল, ভোলা জেলার লালমোহন, নাজিরপুর, চরফ্যাশন, চরকলমি, কুকরি মুকরিসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কালাইয়া হাটে গরু মহিষ বিক্রি করতে আসেন ব্যবসায়ীরা। হাটে গরু কিনতে আসেন চট্রগ্রাম, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় ব্যবসায়ীরা।

রবিবার থেকে হাটে গরু-মহিষ আসা শুরু হয়। নদী পথে ট্রলার, বড় বড় নৌকা আর সড়ক পথে ট্রাক ভরে গরু-মহিষ আসে। সোমবার বেচাবিক্রি শেষে আবার সেগুলো নদী ও সড়ক পথে নিয়ে যাওয়া হয়।

কালাইয়া বন্দরের আরেক ঐতিহ্য ধানহাট। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ধান বিক্রি করতে আসেন কালাইয়া হাটে। নৌপথেই বেশি ধান আসে। এ হাট থেকে হাজার হাজার মণ ধান কিনে নিয়ে যান নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। ধানের মৌসুমে সপ্তাহ জুড়েই কর্মব্যস্ত থাকে কালাইয়া বন্দর।

শুধু গরু-মহিষ বা ধানের কারবারই নয়, নানামুখি ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র কালাইয়া হাট। এই বন্দরে দূরদূরান্ত থেকে আসেন অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এদের কেউ আসেন বাঁশের তৈরি কুলা, ডালা, মোড়া, বা খাঁচা নিয়ে। কেউ আসেন হোগলা পাতায় তৈরি পাটি বা ছিকা নিয়ে। কেউ আসেন শামুকের খোলস থেকে তৈরি চুন নিয়ে। কেউবা আবার গাছের চারা বিক্রি করতে আসেন।

সব মিলিয়ে কালাইয়া এক জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র। অসংখ্য মনোহারি দোকান, রয়েছে হরেক রকম মিষ্টির দোকান। গ্রামের অন্যসব হাটে যেমন থাকে। এ বাজারে এখনো দেখা মেলে হুক্কা খাওয়ার উপকরণ তামাক আর রাব বিক্রেতাদের। সব মিলিয়ে হাজার পেশার মানুষের মিলনমেলা এই বন্দর। বলা হয়, এমন কিছু নেই যা কালাইয়া হাটে পাওয়া যায় না। সবই মেলে এই হাটে।

এম এ হান্নান, বাউফল, পটুয়াখালী
গণমাধ্যমকর্মী

Scroll to Top