তখনো পুব আকাশে সূর্যের দেখা মেলেনি। ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। এরই মধ্যে নিয়তির ওপর ভর করে কাস্তে-কোদাল নিয়ে হাজির হাজারো শ্রমিক। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। ক্রেতারা আসেন আর দরদাম করে নিয়ে যান তাদের।
বলছিলাম শরীয়তপুরের কাজিরহাটের কথা। যেখানে অন্তত ৩০ বছর ধরে চলে আসছে শ্রম বেচাকেনা। প্রতিদিন শ্রমজীবীরা এখানে এসে জড়ো হন। আর খদ্দেররা এসে চুক্তিতে তাদের কাছ থেকে শ্রম কেনেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাজিরা উপজেলার কাজিরহাট বাজারের পূর্ব পাশের ঢাকা-শরীয়তপুর প্রধান সড়কজুড়ে বসে এই শ্রমজীবী মানুষের হাট। বছরের ১০ মাস প্রতিদিন এই হাটে অন্তত দেড় হাজার শ্রমজীবী মানুষ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজ করেন। জেলার জাজিরা উপজেলার পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলাগুলো থেকে এসে কাজের প্রয়োজনে শ্রমিকদের দরদাম করে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেশের উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নরসিংদী, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, রংপুর, জামালপুর, গোপালগঞ্জসহ অন্তত ২৫টি জেলার শ্রমিকরা কাজ করছেন শরীয়তপুরে। পাট কাটা, ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা, মাটি কাটার কাজ করে থাকেন তারা। কাজের ধরন হিসেবে এসব শ্রমিকের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
সরেজমিন দেখা যায়, দীর্ঘ সারি ধরে শ্রমিকরা কাজের জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ ডেকে ডেকে ক্রেতাদের তাদের পারিশ্রমিকের কথা বলছেন। ক্রেতারা এসে তাদের সঙ্গে দামাদামি করছেন। মূল্য নির্ধারণ শেষে অটোরিকশা এবং ভ্যানযোগে গন্তব্যস্থলে রওয়ানা করছেন তারা। যারা অবিক্রীত রয়ে গেছেন তারা বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।
গত তিন বছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর চৌডলা এলাকা থেকে কাজিরহাটে শ্রম বিক্রি করতে আসেন ছাত্তার মোল্লা (৪৬) ও ফারুক পাইকার (৩৫) নামের দুই প্রতিবেশী। তারা মূলত আম বাগানে কাজ করেন। আমের মৌসুম শেষ হয়ে আসলে নিজ এলাকায় তেমন কাজ থাকে না তাদের। তাই বাকি সময়টা শরীয়তপুরে চলে আসেন শ্রম দিতে।
জানতে চাইলে ছাত্তার মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের জেলার আম বাগানে কাজ শেষ হলে শরীয়তপুরে চলে আসি। এখানে প্রচুর কৃষিকাজ আছে। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বিনিময়ে মানুষ আমাদের কিনে নিয়ে যায়। নিজেদের খরচের পর বাকি যা থাকে তা বাড়িতে পাঠিয়ে দেই।’
ফারুক পাইকার বলেন, ‘বছরের তিনমাস কৃষিকাজ করার জন্য শরীয়তপুরে চলে আসি। পাট কাটি, রসুন-পেঁয়াজ লাগাই। যখন কাজের চাহিদা বেশি থাকে আমাদের চাহিদাও বেড়ে যায়। তবে কাজ কমে এলে পারিশ্রমিক কম পাই। তবে প্রতিদিনের টাকা প্রতিদিন পাই বলে ভালো লাগে।’
ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য আলাদা আলাদা শ্রমিক পাওয়া যায় এই হাটে। দরদাম করে শ্রমিক কেনার সুযোগ থাকায় খুশি ক্রেতারাও। নড়িয়া উপজেলার নশাসন থেকে শ্রমিক কিনতে আসা আবু বক্কর খা নামের এক গৃহস্থ বলেন, ‘শ্রমিকের এই হাটটি অন্তত ৩০ বছর ধরে চলমান। আমার অনেক পাটের জমি আছে। এই মৌসুমে পাট কাটার জন্য শ্রমিক নিতে কাজিরহাটে চলে আসি। এখানে ৫০০-৬০০ টাকায় শ্রমিক পাওয়া যায়।’
তবে প্রতিদিন নিয়তি পক্ষে থাকে না সবার। দীর্ঘ প্রতীক্ষায়ও মেলে না কোনো কাজ। মাঝেমধ্যে কিছু শ্রমিক অবিক্রীত থেকে যান। পরের দিন কাজের সন্ধানে আবারও হাটে আসতে হয় তাদের।
এমনই একজন অবিক্রীত শ্রমিক রেজাউল করিম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দামদর বনিবনা না হওয়ায় আজ কাজ পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে বাসায় চলে যাচ্ছি। তবে কাজ থাকুক আর থাকুক প্রতিদিন খাবারের জন্য ২০০ টাকা আর থাকার জন্য প্রতিমাসে ৪০০ টাকা গুনতে হয়। কাজ কম থাকলে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।’
কাজিরহাট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক টেপা বলেন, ‘কাজিরহাটে অন্তত ৩০ বছর ধরে শ্রম বেচাকেনা হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকরা এখানে কাজের সন্ধানে আসেন। হাটে দালাল কিংবা তৃতীয় পক্ষ না থাকায় ক্রেতারা নিজে এসে দামদর কর শ্রমিকদের কিনে নিয়ে যান। আমরাও হাটের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে থাকি।’