ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা-পিতল শিল্পে সুদিন ফিরছে

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। একসময় এই ব্যবসায়ের মন্দাভাবের কারণে অনেক শ্রমিক অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু, তাদের অনেকেই আবার পুরনো পেশায় ফিরে আসছেন। গত পাঁচ বছরে ব্যবসা অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষও আবার কাঁসা-পিতল-তামার তৈরি তৈজসপত্রের দিকে ঝুঁকছেন।

দোকান মালিকরা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কাঁসা, পিতল ও তামার তৈরি তৈজসপত্র বিক্রির গত পাঁচ বছরে বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে যেখানে প্রতি মাসে গড়ে বিভিন্ন দোকানে মাত্র ১০০ কেজি তৈজসপত্র বিক্রি হতো, সেখানে এখন কাঁসার তৈজসপত্র প্রতি মাসে গড়ে ১৫০ কেজি এবং পিতলের তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে ২৫০ কেজিরও বেশি।

এ ছাড়া, তামার তৈরি তৈজসপত্রের বিক্রিও বেড়েছে। তবে, তা কাঁসা ও পিতলের চেয়ে কম বিক্রি হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের আজাইপুর, আরামবাগ, রামকৃষ্টপুর, বটতলাহাট ও শংকরবাটি এলাকায় কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্র তৈরি হয়। একসময় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এসব তৈরি করা হতো। আগে, সহস্রাধিক পরিবার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন তা কমে প্রায় দুইশ হয়েছে। এসব এলাকায় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শোনা যেত খট খট শব্দ। তবে, মাঝখানে ব্যবসায় মন্দা অবস্থা চলার কারণে অল্প কয়েকজন ধরে রেখেছিল তাদের পৈত্রিক ব্যবসাকে।

ধীরে ধীরে সেই মন্দাভাব কেটে উঠতে শুরু করেছে। তাই আবারও জমে উঠছে তাদের ব্যবসা। অনেকেই পৈত্রিক ব্যবসায় ফিরে আসছেন। আবারও এসব এলাকার রাস্তার দু’পাশ থেকে শোনা যায় খটখট শব্দ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘গত কয়েক বছর আগে শতাব্দী পুরনো এই শিল্পে এমন মন্দা অবস্থা শুরু হয় যে, এর সঙ্গে যুক্ত অনেক শ্রমিক পৈত্রিক পেশা ছেড়ে অন্যান্য পেশায় চলে যায়। অনেক ব্যবসায়ীও বন্ধ করে দেয় তাদের পৈত্রিক ব্যবসা।’

তারা দাবি করেন, প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল, এলুমিনিয়াম ও সিরামিক সামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংকটের কারণে কাঁসা-পিতল শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু, কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ার কারণে মানুষ আবারও এর ব্যবহারে ঝুঁকছে, বিক্রিও বাড়ছে। কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্রের সুবিধা হলো পুরনো হয়ে গেলে কেনা দামের চেয়ে সামান্য কম দামে বিক্রি করে আবার নতুন তৈজসপত্র কেনা যায়। যা অন্য কোনো তৈজসপত্রের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।

তারা বলেন, তাছাড়া এখন এর কাঁচামাল সহজলভ্য। তাই পণ্য উৎপাদনে কোনো অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বিভিন্ন দোকানে কাঁসা-পিতল ও তামার তৈজসপত্র বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঁসার তৈরি তৈজসপত্র প্রতি কেজির মূল্য ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা, পিতলের তৈরি তৈজসপত্র প্রতি কেজির মূল্য ৭০০ টাকা। এ ছাড়া, তামার তৈরি তৈজসপত্র প্রতি কেজির মূল্য ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকা।

এসব তৈজসপত্রে নকশার জন্য আলাদা টাকা দিতে হয় নকশার মজুরি হিসেবে। নকশার জন্য খরিদ্দারকে দিতে হয় অতিরিক্ত ৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।

শহরের পুরাতন বাজারের ব্যবসায়ী জননী মেটালের মালিক সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে ব্যবসা খুব খারাপ গেছে। পুরাতন বাজারে কয়েকটি দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তারা পৈত্রিক ব্যবসা ছেড়ে দেয়। তবে, এখন ব্যবসার অবস্থা ভালো, বিক্রি বাড়ছে। আবারও মানুষ এসব তৈজসপত্র কিনছে।’

‘গত বছর করোনার কারণে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তারপরেও খুব প্রভাব পড়েনি, লকডাউন শেষে ভালো ব্যবসা হয়েছিল,’ যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এসব তৈজসপত্র নিয়ে যান। ঢাকা থেকেও পাইকার আসে, তারা এখান থেকে কিনে নিয়ে বিভিন্ন দোকানে সরবারহ করে।’

একই এলাকার ইসলাম বাসুনালয়ের মালিক তালেবুর রহমানেরও পৈত্রিক ব্যবসা এটি। তিনি বলেন, ‘এখানকার বিয়েতে কন্যাপক্ষ কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র দেন। এটা এই অঞ্চলের ঐতিহ্য। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও ঘরে রাখবার জন্য বিভিন্ন উপকরণ উপহার হিসাবে কাঁসা-পিতল বা তামার তৈরি জিনিস দেন। পাঁচ বছর আগে এই উপহারের পরিমাণ কমলেও তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে, এখন বেচা-কেনাও ভালো হচ্ছে।’

শহরের বটতলা হাটের শ্রমিক মোস্তাকিম বলেন, ‘আমি পুরাতন তৈজসপত্র মেরামত ও পালিশের কাজ করি। এ কাজে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাঁসা প্রতি কেজি ১৬০ ও পিতলের তৈজসপত্র মেরামত ও পালিশের কাজে নিই ৫০ টাকা। গড়ে প্রতিদিন আয় হয় পাঁচশ টাকারও বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনার সময় লকডাউনে কাজ বন্ধ থাকলেও কোনো ধার-দেনা করতে হয়নি। জমানো টাকা দিয়েই ওই সময়টা চলে গেছে।’

অপর শ্রমিক আজাইপুরের আবু তাহের বলেন, ‘করোনাকালীন লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকায় কিছুটা কষ্ট হয়েছে। এক আত্মীয়ের কাছে কিছু ধার নিয়েছিলাম, পরে শোধ করে দিয়েছি।’

আবু তাহেরের মতো অধিকাংশ শ্রমিকই লকডাউনে আত্মীয় অথবা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে, তারা পরে কাজ করে সেসব ঋণ পরিশোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।

একই মহল্লার কারখানা মালিক নুরুল ইসলাম। তারয় কাঁসার থালা তৈরির কারখানায় ১৪ জন শ্রমিক কাজ করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘লকডাউনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো ঋণ করিনি, পরে বিক্রি ভালো হওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছি। আমার কারখানায় মাসে ৫০০ কেজি থালা তৈরি হয়। পাঁচ বছর আগে ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি তৈরি করা হত। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ায় ঐতিহ্যটা এখনো টিকে আছে। কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্রের প্রতি আবার দিন দিন আস্থা বাড়ছে মানুষের।’

আরামবাগ মহল্লার মুসলিমউদ্দিন (৬২) বলেন, ‘৫০ বছর ধরে পৈত্রিকসূত্রে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্রায় দুই-আড়াই দশক খারাপ গেলেও গত পাঁচ বছরে ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী ও শ্রমিক কাজ ছেড়ে দিলেও এখন আবার পুরনো পেশায় ফিরে আসছেন।’

আজাইপুর মহল্লার মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন (৫৮) ৪০ বছর ধরে পৈত্রিকসূত্রে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক, মেলামাইনসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি ও কাঁচামাল সংকটের কারণে এই শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন কাঁচামাল সহজলভ্য হয়েছে।’

আরামবাগ মহল্লার আরেক ব্যবসায়ী আবুল ফজল (৫৬) বলেন, ‘তার করখানায় কাজ পাঁচ জন শ্রমিক কাজ করেন। ব্যবসা ভালো হচ্ছে। এখানের তৈরি তৈজসপত্র জেলা ছাড়াও রাজশাহী নওগাঁ, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।’

আরামবাগ মহল্লার শ্রমিক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমি কাঁসার কাজ করে দৈনিক তিনশ থেকে চারশ টাকা আয় করি। কষ্টের কাজ তাই নতুন প্রজন্ম এ পেশায় আসতে চায় না।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রবিউল আলম বাবু বলেন, ‘এখন ব্যবসা ভালো হচ্ছে, উৎপাদন অনেক বেড়েছে। এছাড়া কাঁচামাল খুব সহজলভ্য হওয়ায় ব্যবসায় যে মন্দাভাব এসেছিল, তা এখন আর নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘জেলায় তিন শতাধিক কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্রের দোকান আছে। এর মধ্যে ১২৫টি পাইকারি ব্যবসা করেন। তাদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য অন্যরা কিনে নেন। আমি নিজে ঢাকার মিটফোর্ডে পাঠায়। করোনাকালীন লকডাউনে মূলত দোকান মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের দোকান বন্ধ থাকলেও কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে। এই সাময়িক ক্ষতি প্রায় সবাই কাটিয়ে উঠেছে।’

রবিউল আলম বাবু বলেন, ‘বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় আট হাজার কেজি কাঁসার বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। যার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২ হাজার কেজি পিতলের সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩২ লাখ টকা। এ ছাড়া, তামার তৈরি জিনিস উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচশ কেজি। যার মূল্য সাড়ে তিন লাখ টাকা।’

‘অথচ পাঁচ বছর আগে কাঁসার পণ্য উৎপাদন হতো প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ হাজার কেজির মতো। সেই সময়ের বাজারদর অনুযায়ী এর মূল্য ৬৫ লাখ টাকা। পিতলের জিনিস উৎপাদন হতো ১৫’শ কেজির মতো, যার মূল্য ছিল নয় লাখ টাকা,’ আরও বলেন তিনি।

তিনি জানান, তামার পণ্য উৎপাদন কম হয়। এখন যেভাবে ব্যবসা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ ভালো।

সরকার কম সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে এই শিল্পকে আরও ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে জানান তিনি।

Scroll to Top