শীতের বিদায়ে চলে এলো বসন্ত। ঋতুরাজকে বরণ করতে বাঙালির আয়োজনের শেষ নেই। প্রতি বছরই রূপ-রসের ঝাঁপি নিয়ে আমাদের দুয়ারে হাজির হয় বসন্ত। এই ঋতুর রূপে-গুণে কেবল মানবকুলই নয়, বন-বনানীর বৃক্ষরাজি, নানান রঙের পাখ-পাখালিও উল্লসিত ও উদ্ভাসিত হয় দারুণভাবে। বসন্ত ঋতু কবি, লেখকদেরও দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। যুগে যুগে অনেক কবি, লেখক তাদের লেখনিতে বসন্ত বন্দনা গেয়ে গেছেন।
পহেলা ফাল্গুন বা বসন্তের কথা উঠতেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবিতায় তিনি লিখেছেন- ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত/ শান-বাঁধানো ফুটপাথে পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে।
বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। একটি ফুল, বাসন্তী শাড়ি, প্রেমিকের হাত, শিমুলের রং সব মিলিয়ে এটা এক অন্য প্রকৃতি। বসন্তে প্রকৃতি যেমন মানুষকে সাজায় তেমনি নিজেও সাজে। সে যেন তখন এক সদ্য যৌবনা তরুণী। কোনো তরুণের অপেক্ষায় প্রতি বছর পালা করে আমাদের মাঝে আসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানের ভাষায় সেই ভীরু অপেক্ষারত বসন্ত তরুণী নিয়ে লিখেছেন-
যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে? জানি নে, জানি নে।
সে কি আমার কুঁড়ির কানে কবে কথা গানে গানে
পরান তাহার নেবে কিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে?
কাজী নজরুল ইসলামও কম যাননি বসন্ত বন্দনায়। বসন্ত বন্দনায় তিনি লিখেছেন- বসন্ত এলো এলো এলো রে / পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহরে / মুহু মুহু কুহু কুহু তানে। মাধবী নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে / ভ্রমর গুঞ্জে গুনগুন গানে / পিয়া পিয়া ডেকে ওঠে পাপিয়া / মহুল, পলাশ বন-ব্যাপিয়া / সুরভিত সমীরণ চঞ্চল উন্মন / আনে নব-যৌবন প্রাণে / বেণুকার বনে বাঁশি বাজে / বনমালী এলো বন-মাঝে / নাচে তরু-লতিকা যেন গোপ-গোপিকা / রাঙা হয়ে রঙের বানে।
নির্জনতার কবি জীবনানন্দের মনেও দোলা দিয়েছিলো বসন্ত। জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু ‘হেমন্ত’ হলেও তার অসংখ্য কবিতায় পাওয়া যায় বসন্তকে। তিনি তার ‘সবিতা’ কবিতায় বসন্তকে তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে;
ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি,
তাহাদের সঙ্গে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ বসন্তকে আগ্রাসী ঋতু হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি কবিতা লিখেছেন, বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারো। চোখ ফেরানো যাক তার লেখা কবিতা বসন্ত বন্দনায়। কবি লঘুচালে বসন্ত বন্দনা করেছেন এভাবে-
‘এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,
যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্য খানি
নবীন পল্ববে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।’
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে বসন্ত ঋতুতে প্রকৃতি, প্রেম ও মানবমনের অনন্য বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- বসন্ত এমনি ঋতু এই সময় বুঝি সবাইর মনে প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা।
তবে বসন্ত নিয়ে ভিন্ন মত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি বসন্তকে বলেছেন বিচ্ছেদের ঋতু। ‘অনিমিষ একা’তে তিনি লিখেছেন- বসন্তকে ঋতুরাজ বলার পক্ষে আমি নই। এ ঋতুতে প্রথম আমি প্রেমে প্রত্যাখাত হই। রাতের ময়দানে হাওয়া বইছিল, আকাশে তারা ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল গুটিবসন্ত ছেয়েছে আমাকে।