সারোয়ার হোসেন সামি
বহুল প্রতীক্ষা শেষে ক্যাম্পাস খুললো অবশেষে। সেমিস্টার ফাইনালের ব্রেকটা প্রায় এক মাসের মতোই কাটলো। ঘটনাবিহীন জীবনটা বেশ একঘেঁয়ে লাগলো। এই একঘেঁয়েমি কাটাতে মন বেশ হাহাকার করছিল প্রেমে পড়ার জন্য।
বর্তমানটাও বেশ অদ্ভুত। প্রেমে পড়াটা বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে যেমন রাস্তায় কাউকে দেখলে পছন্দ হতো, তার পিছু নিয়ে বাসায় ফেরার পথটা চিনে নেওয়া হতো। তারপর সেই পথে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতো একপাক্ষিক প্রেমিক। দেখতে দেখতে কোনো এক শুভলগ্নে প্রেয়সীর নজর কেড়ে নিতো এবং নজরানা হিসেবে প্রেয়সীর অর্ধচাঁদের মতো অমলিন হাসি পেতো। ব্যাস! এই তো। এরপর শুরু হতো সেই প্রেমিকের বুকের মাঝে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর দিন।
এখন এই অনুভূতি পাওয়াটা আমার কাছে বেশ দুষ্করই মনে হয়! যা হোক, স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানের নীতি অনুযায়ী আমিও এক মেয়ের প্রেমে পড়লাম। ইনস্টাগ্রামের স্টোরি দেখতে দেখতে তার একপাক্ষিক সাক্ষাৎ পেলাম। জলপাই রঙের শাড়ি এবং ঢেউ খোলা চুল। সেই চুলের মাঝে আড়াল হয়েছিল তার স্নিগ্ধ হাসি, মোটামুটি বিষম খেয়ে গিয়েছিলাম মুগ্ধতায়! যদিও ব্যাপারটা প্রেমে পড়ার পর্যায়ে যায়নি। তবে পছন্দের মানুষ বলা যায়।
মেয়েটির নাম তিতলী। খুব মিষ্টি একটা নাম। তার সাথে কথা বলা শুরু করবো কীভাবে! এই ভেবে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। কারণ অনলাইনে কথা বলার ব্যাপারে আমি বেশ আনাড়ি! অনেকে আমার অনলাইন পার্সোনালিটি দেখে আমাকে বেশ গুরুগম্ভীর মনে করেন। এই কনভার্সেশন করার ব্যাপারে আমি বেশ প্রাচীন আমলের মানুষ বলা যায়। এখনো পনেরো-ষোলো সালের মতো স্টার্টার মাথায় আসে। যেমন- ‘তোমার বাসা কোথায়? কয় ভাই-বোন তোমরা? বাবা কী করেন? দাদা আছে? রাতে কী দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করেছো?’
এই সূত্র এখন নাকি খাটে না। তাই ভিন্নপন্থা অবলম্বন করলাম। কথা বাড়ানো যায় এমন স্টোরির রিপ্লাই দিয়ে। ঘটনাক্রমে জানতে পারলাম, সে আমার ভার্সিটিরই ব্যাচমেট। মেঘ না চাইতে জল পাওয়ার মতো ব্যাপার। কথা বেশি এগোতে পারিনি। কারণ এক পর্যায়ে আমার নিজেকে একজন ইন্টারভিউয়ার মনে হচ্ছিলো।
অতঃপর অনলাইনে আমি আর কথায় আগালাম না। বাস্তববাদী একজন মানুষ আমি। ক্যাম্পাসে সুযোগ করে দেখা হলেই বাকি ব্যাপার সামলাবো এ প্রতিজ্ঞা করলাম নিজের কাছে। তখন থেকেই ক্যাম্পাস খোলার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শুরু করেছিলাম।
ক্যাম্পাস খোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ সুন্দর দিনই বাছাই করেছে। আকাশে ধূসর মেঘ আর শুভ্রতার ছড়াছড়ি। আষাঢ় মাসের অবিরাম বৃষ্টি শেষে চারদিক যেন আবারও সজীব হয়ে উঠেছে। তেমনই সজীব-সতেজ হলো মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভোগা আমার মন। নিজেকে মনে হচ্ছে যেন ষোলো বছরের কিশোর। সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে। বড় হওয়ার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষায় চারদিকে তাকিয়ে বেড়াচ্ছে।
বেলা বারোটা, সবে ক্লাস শেষ হলো। দুটা থেকে ল্যাব শুরু। এই ব্রেকটাইমে আমি পকেট গেটের কাছে কদমতলায় বসে আছি। হাতে বেশ জটিল একটা বই, হেনরি ফোর্ডের লেখা ‘ইন্টারন্যাশনাল জিউ’। পাশাপাশি মাথার মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত আনমনে গুনগুন করছিল, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখরও বাদলও দিনে…’। হঠাৎ পকেট গেটের দিকে চোখ পড়লো। কলরব প্রাঙ্গণে একা এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বেশ ভালোভাবেই চিনতে পেরেছি আমি, তিতলী।
তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, এই পৃথিবীতে তার আগমন শুধু একরাশ বিষণ্ণতা রেডিয়েশন আকারে সবার মাঝে বিলি করার জন্য। তবুও আমার কাছে এই বিষণ্নতা যেন সৌন্দর্যের এক অভিনব বহিঃপ্রকাশ। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা তার বিষণ্ন মুখ যেন সকালের সূর্যস্নানে ঘেরা স্নিগ্ধ ভেলভেটের চাঁদরের উজ্জ্বলতার মতো। তাই দূর থেকে তাকে আমার ট্রয় নগরীর হেলেনের মতো মনে হতে দ্বিধাবোধ হলো না। বইটি বন্ধ করে তিতলীর দিকে আগালাম। পাশে দাঁড়ানো মাত্রই চমকে দিয়ে বললাম, ‘গাছের পাতার মাঝ দিয়ে মেঘলা আকাশ দেখার চেয়ে, রোদের জন্য পথের মাঝে গাছের একঝাঁক পাতার ছায়ার নাচ দেখাটা বেশ সুখকর স্মৃতি তৈরি করবে।’
তিতলী বেশ চমকে উঠলো, পাশে ফিরে তাকালো। কিছুটা পরিচিত আবার অপরিচিত এমন দ্বিধা জর্জরিত চাহনিতে আমার দিকে তাকালো কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।’
আমি আমার আহত হৃদয়কে প্রশ্রয় দিয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘যেহেতু মনে করতে পারছো না, সেই পরিচয়ের স্থানটা না মনে করাই শ্রেয়। তার চেয়ে বরং আজ নতুনভাবেই পরিচিত হই। আমি শুভ্র, আশা করি আমরা একই ব্যাচের হবো। নয়তো এই শুভ সময়ে দেখা হতো না আমাদের।’
কিছুটা ইতস্তত হয়ে তিতলী ছোট বাক্যে জবাব দিলো, ‘আমি তিতলী।’
তার ইতস্ততা দূর করার জন্য পরিচয়পর্ব আর না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকের আকাশটা কেমন লাগছে? বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ লক্ষ্য করলাম, এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছো! বিশেষ কিছু আছে কি?’
নিজ অনুভূতি প্রকাশের সুযোগে তিতলীর জড়তা বেশ দূর হলো। সাবলীলভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘বিশেষ কিছু না। এই বর্ষা উপভোগ করাটাও না আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে চলে। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর না? এই যে কেউ কেউ নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে বেড়ায়। আবার কেউ কেউ বৃষ্টি শেষে আকাশের মেঘের দিকে মিলানকোলিয়ার আভাস খুঁজে বেড়ায়।’
কথাগুলো তিতলী অন্তঃসারশূন্য হাসি জড়িয়ে বলছে। আমি একটু হাঁটা শুরু করলাম তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে। সে-ও আমার সাথে পথ ধরলো।
‘তোমার চিন্তাধারার প্রথম শ্রেণির মানুষটা-না আমি, এই যে চারদিকের গাছগুলোর দিকে তাকাও। মনে হচ্ছে না, তারা আবার প্রাণ ফিরে পেল? এই গাছগুলো মনে হয় তাদের নিজেকে প্রকাশ করার অনুভূতি আমাদেরও দান করে। আমার মনে হচ্ছে, আমি আবার কৈশোরে ফিরে গেছি! একধরনের চঞ্চলতা মনে কাজ করছে।’
তিতলীর মুখে এইমাত্র অমলিন ও নির্ভেজাল হাসি দেখতে পেলাম। সে বেশ চঞ্চলভাবেই উত্তর দিলো, ‘এই সৌভাগ্য কয়জনেরই বা হয়! যা হোক, সেই বয়সের মতো দিনের বেলা চোখ খোলা রেখে স্বপ্ন দেখতে দেখতে রাস্তায় আবার আছাড় খেও না।’
রাস্তায় ছোটরা ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প হিসেবে ছোট পাথর বসিয়েছে। আমি তিতলীর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আরেকটু হলে পাথরে পা ফসকে কুপোকাত হয়ে যেতাম। নিজের অসচেতনতা দেখে বেশ মজা লাগলো। হাসতে হাসতে তিতলীকে বললাম, ‘তিতলী শোনো, আমরা যদি এখন এই বঙ্গদেশে না থাকতাম। ধরে নাও ফ্রান্সের প্যারিসেই এমন মেঘলা দিনে দেখা তোমার সাথে। তোমাকে অবশ্যই একটা কফিশপে ক্যাপাচিনো এবং সাথে চকলেট খোয়াসোঁ উপভোগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতাম। তবে সৌভাগ্যবশত এই বঙ্গীয় ক্যাম্পাসে দেখা হওয়ার সুবাদে আমার খুবই প্রিয় জায়গা বিএমডব্লিউয়ের সামনের এক কাপ চায়ের আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ হাতে রয়েছে!’
তিতলী তার চিলতে হাসি হেসে বললো, ‘আচ্ছা, আচ্ছা চলো।’
আমরা বিএমডব্লিউয়ের দিকে একসাথে হেঁটে আগাচ্ছি। আকাশে একই রকম আবহ এখনো বিরাজমান। মৃদু ঠান্ডা হাওয়া পাশ ঘেঁষে যাচ্ছে। আমরা দুজনই চুপচাপ হাঁটছি। এক উপভোগ্য নীরবতা। আমার মনে হচ্ছে, পেছন থেকে বাপ্পা মজুমদার তার ‘পরী’ গানটি গাচ্ছেন।