ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাখরখানি

পুরান ঢাকার বাখরখানি বাংলাদেশের সেই সব খাদ্যদ্রব্যের একটি যা মুঘল আমল থেকেই প্রচলিত। ৪০০ বছরের ইতিহাস বয়ে বেড়ানো পুরান ঢাকায় আজও সকালের নাস্তায় কিংবা বিকেলের চায়ের কাপ সর্বত্রই বাখরখানির বিচরণ।

বাখরখানি তৈরির উপকরণ

নবাবদের আমলে বাখরখানী তৈরি হতো মালাই মাখন দিয়ে। ময়দার সঙ্গে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে খামির তৈরি করে বাখরখানি বানানো হতো।বর্তমানে মূলত ময়দা দিয়েই তৈরি হয় বাখরখানী।ময়দার সঙ্গে লবণ, ডালডা,ঘি ও পানির মিশিয়ে খামির তৈরি হয় বাখরখানীর।প্রচলিত আছে,ভালো বাকরখানি সেটাকেই বলা হবে, যা মুখে দিলেই মিলিয়ে যাবে মাখনের মতো। হাতের স্পর্শেই ভেঙে হবে ঝুরঝুরে।

পুরান ঢাকার বাখরখানি তৈরির পিছনের ইতিহাস

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী এই বাখরখানির তৈরির পিছনে রয়েছে এক অমর প্রেম কাহিনী। কাহিনী হলো একজন ক্রীতদাস এর। তুরকিস্তান থেকে ক্রীতদাস হয়ে এই বাংলার মাটিতে এসেছিল আগা বাকের নামের এই ছেলেটি। তৎকালীন বাংলার নবাব মুর্শেদকুলি খান এই ছেলেটিকে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে এই ছেলেটি কোন সাধারন ছেলে নয়। তিনি আগা বাকের খান কে তার দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাকে লেখাপড়া শেখাতে থাকেন, সাথে তাকে সমর বিদ্যাও শেখান। কিছুদিনের মধ্যেই সমর বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন আগা বাকের নামক জোয়ান। নবাব মুর্শিদকুলি খান আগা বাকের কে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ফৌজদারি দায়িত্ব দেন। সেসময় খনি বেগম নামের একজন নর্তকীকে ভালো লেগে যায় বাকের এর। অত্যন্ত রূপবতী এই নারীকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেন আগা বাকের। কিন্তু তার সব আশার রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন উজির জাহেন্দা খার পুত্র নগর কতুয়াল জয়নাল খা। জয়নাল খাও খনি বেগমের রূপের কাছে বাধা পরে যান। কিন্তু জয়নাল খা খনি বেগম কে প্রস্তাব করে এবং খনি বেগম এর কাছে প্রত্যাখ্যাত হন। তাই জয়নাল খা খনি বেগম কে তুলে নিয়ে যান দক্ষিণ বঙ্গের দিকে, খবর পেয়ে আগা বাকের চলে যান খনি বেগম কে উদ্ধার করতে। আগা বাকের এর কাছে জয়নাল খা পরাজিত হন। জয়নাল পরাজয় মেনে নিতে না পেরে বাকের এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। তিনি তার পিতা তৎকালিন উজীর এর কাছে খবর পাঠান যে আগা বাকের তাকে হত্যা করে লাশ গুম করেছে, এই খবর পেয়ে উজীর যান নবাব এর কাছে বিচার চাইতে, নবাব নিশপক্ষ বিচার করে বাকের কে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু এ যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়, বাকের ক্ষুদার্থ বাঘ কে হত্যা করে বাঘের খাঁচা থেকে বীরের মতো বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে জয়নালের মিথ্যে মৃত্যুর খবর চারিদিকে প্রচার হয়ে যায় এবং উজির নিজে নিজের ছেলেকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করেন। তবে আঘাতপ্রাপ্ত জয়নাল মৃত্যুর আগে খুনি বেগম কে হত্যা করে মারা যান। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন তিনি খনি বেগমকে না পেলে খনি বেগমকে আর কারো হতে দিবেন না। এই ঘটনায় বাকের অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। তিনি বাকি সারা জীবন খনি বেগমের স্মৃতির সাথে জীবন যাপন করেছেন। খুনি বেগমকে সমাহিত করা হয়েছে দক্ষিণ বঙ্গে। উল্লেখ্য যে, বর্তমান বরিশাল জেলা পূর্বে বাকেরগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। এই আগা বাকের এর নাম অনুসারেই বাকেরগঞ্জ নামকরণ করা হয়েছিল। বাকের তার প্রিয়তমা খনি বেগমের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে এক বিশেষ ধরনের শুকনো রুটি প্রচলন করেছিলেন। নিজের নামের সাথে খনি বেগমের নাম মিলিয়ে যার নাম তিনি রেখেছিলেন বাকেরখনী। এই বাকেরখনি ই লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে বর্তমানে বাখরখানি নামে পরিচিত হয়েছে। পুরান ঢাকার প্রখ্যাত লেখক নাজির হোসেন, তার কিংবদন্তী ঢাকা নামক গ্রন্থে এই বাখরখানির ইতিহাস উল্লেখ করেছেন।
দেশে বিদেশে বিস্তার

জনশ্রুতি রয়েছে, লালবাগ কেল্লার কাছে ই প্রথম পুরান ঢাকার বাখরখানি দোকান গড়ে উঠেছিল। এরপর এখন থেকে ধীরে ধীরে পুরান ঢাকার চানখারপুল, আগা নবাব দেউড়ী, কোতয়ালী, চকবাজার, বংশাল, হাজারীবাগ ও সূত্রাপুর এলাকায় বিস্তার লাভ করে এই বাখরখানির দোকান। এছাড়া, পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের দুপাশে ও গড়ে উঠেছে বাখরখানির বেশ কয়েকটি দোকান। আর বর্তমানে ঢাকার মোটামুটি সব অঞ্চলেই কম বেশি চোখে পড়ে বাখরখানিড় দোকানের দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যা এখন বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকে বাখোরখানী যাচ্ছে ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, মধ্যপ্রাচ্য সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে। এর অতুলনীয় স্বাদ একে দেশে বিদেশে সমান জনপ্রিয় করে তুলেছে।

একসময় এই বাখরখানি ছিল নবাব ও আমিরদের প্রিয় খাবার। গরম রসগোল্লা অথবা মিষ্টি পায়েস বা এক কাপ চা সবকিছুর সাথেই বাখরখানি দারুন উপাদেয়। এছাড়াও গরু খাসি বা মুরগির মাংসের সাথেও এর স্বাদ অতুলনীয়। আমাদের দেশে বখরখানি খান নি বা চেনেন না এমন লোক হয়তো কম ই খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু এর পিছনে লুকিয়ে থাকা এই বিরহ ভরা প্রেম কাহিনী টি হয়তো অনেকের ই অজানা। তাই পরিশেষে একটি কথাই বলবো, আমাদের দেশের ইতিহাস কে জানার আরো অনেক কিছু রয়েছ, যা জানা বাংলাদেশের সন্তান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।

Scroll to Top