অনেক পরিচয় তার। তবে গানের মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। মুক্তিযুদ্ধ, সরকারি চাকরি, গান প্রযোজনা থেকে হয়ে উঠেছেন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। নিজেই নিজের পরিচয় হাসান মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশ শোনাবেন ইমরোজ বিন মশিউর
প্রথমেই ‘চেনাসুর’ প্রসঙ্গে আসি। ‘চেনাসুর’ আপনার কতটা ভালোবাসার আর কতটাই বা বাণিজ্যের?
‘চেনাসুর’ প্রধানত আমার একটা আইডেন্টিটি। আমার গান লেখা শুরু ১৯৭৮-এ। এর আগেও দু-একটা লিখেছি রেডিওতে, বেনামে। তখন রেকর্ডের যুগ, ক্যাসেটের প্রচলন হয়নি। ১৯৮২ সালে আমি চেনাসুর প্রতিষ্ঠা করি। আর এর অন্যতম কারণ ছিল নিজের ধ্যান-ধারণা চিন্তাচেতনা দ্রুত অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। নিজের প্রতিষ্ঠানের সুবিধা হলো স্বাধীনভাবে কাজ করা যায়। ঢাকা গ্রামোফোন কোম্পানির কর্ণধার সালাউদ্দিন সাহেবের পরামর্শে আমি চেনাসুর প্রতিষ্ঠা করি। তিনিই বলেন, ‘অন্যের জন্য গান না লিখে বা অন্যের দরজায় না ঘুরে নিজে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তৈরি করো।’ চেনাসুর যতটা ভালোবাসার বা ব্যবসার তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মপরিচয়ের।
কোন পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন?
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং এটা আমার অহংকার। আমি দেশ-মাটির টানে যুদ্ধে যাই, তখন আমি দশম শ্রেণির (নিউ টেন) ছাত্র। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিচয় সবার ওপরে, এর চেয়ে বড় অহংকারের বিষয় আর কী হতে পারে। একটা জাতি আমাকে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের জায়গায় স্থান দিয়েছে। এই পরিচয়ের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। আর গানের ভুবনে আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন গীতিকবি। আমি গীতিকার হাসান মতিউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন আর গীতিকার হওয়া আমার জীবনের সেরা চাওয়া।
সাড়ে চার দশক ধরে গান লিখছেন, গানের মাধ্যমে আপনি আসলে ঠিক কী বলতে চেয়েছেন?
সবচেয়ে দ্রুত মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার সেরা মাধ্যম হলো গান। এটা মানুষের সঙ্গে কানেক্টেড হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ বলে আমার মনে হয়। আমি আমার গানের মাধ্যমে মানুষের গল্প বলতে চেয়েছি। আমি মূলত লোকগানের গীতিকার। মানুষের সহজ-সরল জীবন, তাদের সম্পর্ক, জীবন, প্রেমন্ডভালোবাসার এসবই আমি বলতে চেয়েছি। আমি এ দেশের সহজ মানুষের সরল জীবনের গল্প গানে গানে বলতে চেয়েছি।
জাতির জনককে নিয়ে লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটির গীতিকার আপনি। কার গলায় গানটি শুনতে বেশি ভালো লাগে?
গানটি প্রথমে গেয়েছিলেন আমাদের মলয় দা (মলয় কুমার গাঙ্গুলি), ১৯৯০ সালে। পরে সাবিনা আপা (সাবিনা ইয়াসমিন) গানটি করেন। তবে সাবিনা আপা গানটি গাওয়ার আগে মলয় দার কণ্ঠেই গানটি ভালো লাগত। সাবিনা আপা গাওয়ার পর তার গলায় গানটি অন্য মাত্রা পায় এবং সন্দেহাতীতভাবে সাবিনা আপার গলাতেই এটা বেশি সুন্দর (মলয় দা, ক্ষমা করবেন)।
‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত’ গানটির প্রথম রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি নিয়ে দেশ রূপান্তরের পাঠকদের কিছু বলুন?
মলয় দার কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করি তেজকুনীপাড়ার ঝংকার স্টুডিওতে। ১৯৯০ সালে এ শহরে প্রথম দু-তিনটি স্টুডিওর এটি ছিল একটি। আমাদের কাছে এটা একটা সবলীল বিষয় ছিল। কেননা আমরা নিয়মিতই গান লিখি আর রেকর্ড করি। ওই দিন দুটি গান রেকর্ড করি ময়ল দার কণ্ঠে। একটি নেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে আর ওই গানটা। গানটির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন প্রয়াত আলমাস আলী দেওয়ান (রজ্জব আলী দেওয়ানের ছেলে)। আব্দুর রশিদ ওই গানে বাঁশি বাজিয়েছিলেন। গানে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-এর একটা বাঁশি বন্দনা ছিল। ওইটা রাখার দাবি ছিল আমার। রেকর্ডিং হওয়ার পর যখন আমরা শুনতে গেলাম, দেখলাম, ওইটা একটা বিস্ময়কর কিছু হয়েছে, মাস্টারপিস। একটা অন্য রকম ভালো লাগায় মন ভরে উঠল। খসরু ভাই (ঝংকার স্টুডিওর মালিক) বললেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তাকে নিয়ে এমন অসাধারণ গান আর হয়নি। আমি কখনোই ভাবিনি, এ গানটি এত বড় একটি কিছু হবে।
চেনাসুরের সেই হাসান মতিউর রহমান কী এখনো আছেন?
আছে। সেই আগের মানুষটিই আছে। তবে ফরম্যাট বদলেছে। আগে গ্রামোফোন রেকর্ড, অডিও ক্যাসেট এবং সিডিতে ছিল। এখন ইউটিউবে। মিউজিক শেয়ারিং সোশ্যাল এই প্ল্যাটফর্মে চেনাসুরের শ্রোতা (সাবস্ক্রিপশন) এখন ২১ লাখ। আরও একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে ‘গানমতি’। প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন গান রিলিজ হচ্ছে। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যত গান লিখেছি, এর প্রায় সবই এই চ্যানেল দুটিতে পাওয়া যাবে। চেনাসুর বা হাসান মতিউর রহমান থেমে নেই, তারা তাদের কাজ ঠিকই করে যাচ্ছে। এই দুটি চ্যানেলর ৯৮ শতাংশ গানই আমার লেখা।
হাজারো গান লেখা ‘হাসান মতিউর রহমান’দের কী চাকরি বা ব্যবসা করে পেট চালাতে হয়?
অন্যদের হয় কি না, জানি না। আমি গান লিখেই চলি। যারা দুটির মাঝখানে থাকে তাদের ঝামেলা হয়। যারা দুই নৌকায় পা দেয়, গান লিখতে চায় আবার চাকরি-ব্যবসাও করতে চায়, সমস্যা তাদের। আর যারা একটাই করতে চায়, তাদের সমস্যা হওয়ার কথা না। আমার অন্তত কোনো দিন হয়নি।
ট্র্যাডিশনাল বা কনভারসেশন ফোক গানের এসময়ের শীর্ষ গীতিকার আপনি। এই জনরার গীতিকার হিসেবে এই তালিকায় আর কাকে কাকে রাখবেন?
প্রশ্নের প্রথম অংশ নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আর দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে বলব, শাহ আলম সরকার ছাড়া আর আমি খুব একটা কাউকে দেখি না।
মৃত্যুর পরও মানুষ তার কাজ দিয়ে বেঁচে থাকে। আপনি তো অনেক কিছু করেছেনআপনি কী হিসেবে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে চান?
আমি পারব কি না, জানি না। তবে আমি একজন গানের মানুষ। যদি মৃত্যুর পরও কারও হৃদয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ থাকে তাহলে আমি গানের মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই।
ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত’ গানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গানটির শুধুই একজন শ্রোতা হিসেবে বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কর্র্তৃপক্ষ কী করবে না করবে, এটা তাদের বিষয়। তবে সাধারণ শ্রোতা হিসেবে এ গানটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাবে তা মনে করি না। তবে নতুন প্রজন্মের এ গানটি সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার। উদ্দেশ্য সেটি হলে একজন শ্রোতা হিসেবে আমার আর কিছু বলার নেই। এ গানটি গান হিসেবেই বহুদিন মানুষের অন্তরে থাকবে এর জন্য এটিকে পাঠ্যপুস্তকে স্থান দেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না।