১২ সেপ্টেম্বর শাহ আব্দুল করিমের ১৫তম প্রয়াণ দিবস। মহর্ষি এই মানুষটির জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী এলে নিজ গরজেই লেখার কলম হাতে নেই। লিখতে চাই তাকে নিয়ে অন্য কিছু ভিন্ন আঙ্গিকে। যে আব্দুল করিমকে জোরজবরদস্তি করে ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে একটি মাত্র আবরণে ঢেকে রাখতে চান সুধীমহল; আমি সেই আবরণ ছিঁড়ে শাহ আব্দুল করিমের ‘করিম ভাই’ হয়ে ওঠার নেপথ্যের কথা বলতে চাই।
যেখানে আব্দুল করিম শুধুই দেহ সাধনায় মগ্ন একজন সমাজবিচ্ছুত সাধক নন, যেখানে করিম শুধু সারিন্দা বেহালা হাতে গান গেয়ে বেড়ানো অসহায়, দরিদ্র কোনো বাউল নন; এরও ঊর্ধ্বে কিছু। এর জন্য প্রয়োজন চিরায়ত পাঠের বাইরে এসে নতুন করে আব্দুল করিমকে পড়া, জানতে চাওয়া, সন্ধান করা। সেরকম নতুন কিছু বলার জন্যই আজকে এই লেখা।
শাহ আব্দুল করিমকে ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে ভজন, সাধনে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু, তাকে শুধুই একজন বাউল বলে এই গণ্ডিতে আটকে রাখার পক্ষে আমি নই। কারণ, আব্দুল করিমের সঙ্গীত জীবনে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে দেখতে পাই— নিগুঢ় বাউল সাধনা করলেও এ মানুষটির সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ছিল আপোষহীন সংগ্রাম। এই সংগ্রাম সমাজকে ঘিরে, সমাজের নানা উগ্রবাদী সমস্যা ঘিরে। কখনো বা করিমের এই আপোষহীন সংগ্রামের কথায় প্রতিফলিত হয়েছে দেশ-কালের রাজনীতির হালহকিক্বত।
তিনি শুধু ‘ময়ুরপঙ্খি নাও’ রূপকের মানব দেহে পড়ে থাকেননি। নিজের ভাবনা, গানের গতিপথকে সর্বদা চালিত করেছে এক নিত্য সংগ্রামের দিকে। ফলে, তার আশেপাশের মানুষের কাছে ‘বাউল সম্রাট’ এর চাইতে তিনি বেশি বিবেচিত হয়েছেন সকলের ‘করিম ভাই’ হিসেবে। এই করিম ভাই হয়ে ওঠার নেপথ্যে আছে এই সমাজের নিপীড়িত মানুষকে ঘিরে শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে গেয়ে ওঠা গান।
বাংলাদেশের আর কোনো বাউল যা করেননি তার সবই করেছেন আব্দুল করিম। এমনকি লালন সাঁই সমাজ সংস্কারকরূপে কিছুকাল আবির্ভূত হলেও শেষমেষ ঠাঁই নিয়েছেন দেহকেন্দ্রিক নিগুঢ় তথ্যে। হিন্দু-মুসলিম সমস্যা তার গানে এসেছে একান্তই সময়ের সমস্যা হিসেবে। শাহ আব্দুল করিম এখানেই সকল বাউল থেকে অনন্য, ব্যতিক্রম।
তিনি দেহ সাধনা দিয়ে সাধক জীবন শুরু করলেও সবশেষে বেছে নিয়েছিলেন আপোষহীন সংগ্রামের পথ। তার কাছে দেহের সাধনার চাইতে দেহধারী মানুষের মুক্তির সংগ্রাম হয়ে উঠেছে বেশি প্রাসঙ্গিক। ফলে তিনি যখন বলেন— ‘এ দেশে বিপ্লব হোক, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। মানুষ মানুষের মতো বাঁচার অধিকার পাক…’ তখন আর করিম ভাইকে বাউল মনে হয় না। মনে হয় কোনো সমাজসচেতন ইন্টেলেকচুয়াল। এই গুণটিই তাকে করেছে অন্যদের চেয়ে উঁচু।
আব্দুল করিম বুঝতে পেরেছিলেন দেহের সাধনা করা মূলে আত্মকেন্দ্রিক সাধনা। এতে সমাজে ভূমিকা রাখার সুযোগ কম। অথচ, তিনি সমাজ সংগ্রামে অংশ নিতে চেয়েছেন যেন সবসময়। ছেলেবেলা ভাতের বিনিময়ে গরু রাখালির কাজ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞা, দেশভাগের যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় এর সব করিম প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এ ব্যাপারগুলোই তাকে তাড়িত করেছে আপোষহীন বিপ্লবের দিকে।
লোক গবেষক সাইমন জাকারিয়া একবার শাহ আব্দুল করিমকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। অর্থাৎ, একজন বাউল হয়েও যা বাউলদের কাজ না (সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংগ্রামে অংশ নেওয়া) তা কেন তিনি করছেন? উত্তরে করিম বলেছিলেন— ‘মানুষের খবর জানার জন্য। আমিও মানুষ, আপনিও মানুষ। এই মানুষের খবর লওয়া দরকার।’ আব্দুল করিম উল্টো প্রশ্ন তুলেছিলেন— ‘সাধকেরা কেন এটা এড়িয়ে যাবে? মানুষ হইলে মানুষের খবর নিতে হবে…’।
শাহ আব্দুল করিম দেশভাগের ঠিক পরপর বই লেখা শুরু করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তার গানের বই বাজারে আসতে শুরু করে। তাঁর প্রথম বই ‘আফতাব সঙ্গীত’। ১৯৫৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অঙ্গনেও পরিচিতি পেতে থাকেন করিম। সেসময় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গণসঙ্গীত গেয়ে মানুষকে সংগঠিত করার কাজটি অনেকের মতো করেছেন তিনিও। মাওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দি, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বরেণ্য রাজনীতিবিদরা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন করিমের গান শুনে।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্ফুরণ দেখে আশির্বাদপ্রাপ্ত হয়ছিলেন ভাসানীর কাছ থেকে। এর রেশ ধরেই হয়তো ১৯৫৭ সালে নিজের লেখা দ্বিতীয় বইটিতে দেখা যায়, শাহ আব্দুল করিমের গণসঙ্গীত লেখা ও গাইবার প্রতি ঝোঁক। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও নীরব থাকেননি এই সংগ্রামী শিল্পী। একের পর এক গণসঙ্গীত লিখে, দেশাত্বপ্রেমের গান লিখে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছেন সাধারণ মানুষকে। কারণ, ন্যায় আর অধিকারের সংগ্রামের প্রতি শাহ আব্দুল করিমের ছিল পূর্ণ আস্থা।
শাহ আব্দুল করিমের রাজনৈতিক অবস্থানের চূড়ান্ত বাস্তব রূপ দেখা যায় ১৯৯৭ সালে, যখন তিনি ‘বাঁচতে চাই’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন নিজ প্রচেষ্টায়। উদ্দেশ্য নিপীড়িত সাধারণের পক্ষে, শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে একত্র করে সংগ্রাম চলমান রাখা। ১৯৯৮ সালে পড়ন্ত বয়সে লেখা ‘ভাটির চিঠি’ বইয়ে আব্দুল করিমকে পাওয়া যায় একদম পুরোদস্তুর সমাজ সংগ্রামী হিসেবে।
সারাজীবন বাউল গান গেয়ে আসা করিম শেষজীবনে এসেও এই মানুষকেই মূল্য দিতে চেয়েছেন দেহসাধনার চাইতেও বেশি। তার সাধনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ, মানুষকে ঘিরে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতি। যখন আব্দুল করিম গেয়ে ওঠেন— ‘বাংলার সার্বভৌমত্ব রাখতে যদি চাও/শোষণের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে দাঁড়াও’ তখন তাকে বাউল কম একজন বিপ্লবীই মনে হয় বেশি।
আমি বলি- সিলেটে যতো লোকশিল্পী আছেন, তারা সকলেই এ অঞ্চলের সম্পদ। কিন্তু, শাহ আব্দুল করিম ছিলেন এদের মধ্যে নায়ক। যিনি একাধারে বাউল গান গেয়েছেন; কিন্তু প্রয়োজন বোধ থেকে কণ্ঠে, সুরে তুলে ধরেছেন এদেশের নিপীড়িত মানুষের মর্মকথা।
শাহ আব্দুল করিমকে বহু উপাধির মোড়কে ঢাকা যাবে, তর্ক-বিতর্ক করা যাবে; কিন্তু সমাজ সংগ্রামী শাহ আব্দুল করিমকে আপনি শুধুই ‘বাউল সম্রাট’ তকমা দিয়ে গণ্ডিতে বেধে রাখা তার সাধনকর্মের প্রতি অবিচার করা হবে।
তাঁর রাজনৈতিক কণ্ঠটি আমরা যতোদিন শুনবো না, পাঠ করবো না ততোদিন তিনি একজন গানের মানুষ হয়েই রইবেন, প্রাণের মানুষ না। অথচ, তিনি সমাজের প্রাণের দাবিই তুলেছেন সময়ে সময়ে তার গানগুলোতে।
শ্যামলাল গোসাঁই, সংস্কৃতি কর্মী ও লেখক