আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এক প্রাচীন সভ্যতার আবাসভূমি। এদেশের রয়েছে হাজার বছরের গৌরবময় সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। গবেষকদের মতে, খ্রীষ্ট-জন্মের ছয় হাজার বছর পূর্বে’ও এই বঙ্গে বা বাংলায় জনবসতি ছিল এবং ‘বাং’ গোষ্ঠী বা ‘বাং’ জাতীয় লোকেরাই এদেশের আদি বাসিন্দা। পাহাড়-নদী -সমুদ্রবেষ্টিত প্রকৃতির সন্তান এদেশের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী ‘বাং’ গোষ্ঠীর লোকদের কেউ সরাসরি পদানত করে শাসন করেছে—-এমন প্রমাণ ইতিহাসে নেই।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি, জনগোষ্ঠী এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসেছে জীবিকার অন্বেষায়, বসতি স্থাপনের তাগিদে, ধম প্রচারের লক্ষ্যে কিংবা শাসনের মানদণ্ড হাতে। তাদের অনেকেই মিশে যায় আমাদের মূল স্রোতে। দ্রাবিড়, আয, মোঙ্গলীয়, আদি—অস্ট্রেলীয়, ভোট-চীনা, আরব, আবিসিনীয়, তুকী, মোগল, পতুগীজ, মগ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর রক্ত ‘বাং’ বা ‘বাঙ্গাল’ এর ধমণীতে মিশে ‘বাঙালী’ জাতিকে করেছে বৈচিত্র্যময়।
এজন্য বলা হয়ে থাকে, বাঙালী জাতি শংকর জাতি। ‘বাং’ ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বাঙালীরা’ই এদেশের সব’প্রাচীন বাসিন্দা, এদেশেরই ভূমিজ সন্তান। এদেশে বাঙালীরাই গড়েছেন স্থায়ী জনপদ, যদিও গত কয়েক শতাব্দী ধরে যে বিরাট এলাকাকে আমরা ‘বঙ্গ’ বা ‘বঙ্গদেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছি তা শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূবে অখণ্ড দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল না।
তখন এই দেশ গৌড়, পুণ্ড্র, বঙ্গ, উপবঙ্গ, চন্দ্রদ্বীপ, বরেন্দ্রী, সূক্ষ্ম, হরিকেল, সমতট ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ‘শাহে বাঙালিয়ান’ উপাধি গ্রহণ করে বঙ্গদেশের বেশিরভাগ এলাকা দখলের মাধ্যমে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে একক শাসনের অধীনে আনেন। তবে বঙ্গদেশ বা বাঙ্গালা নামটি একদিনে বা এক শতাব্দীতে হয়নি। তা দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই অনেক কবি- সাহিত্যিক তাদের লিখনীতে তা তুলে ধরেছেন, তবে তা বিচ্ছিন্ন, সঙ্কীর্ণ বা অস্পষ্ট অর্থে। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের খ্যাতনামা কবি ভারতচন্দ্র রায়ই প্রথম বৃহত্তর বঙ্গকে ‘বাঙ্গালা’ এবং অধিবাসীকে ‘বাঙালী’ বলে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ করেন।
অবশ্য ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ ও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরিপ্রেক্ষিত অনেক বদলে গেছে, বর্তমানে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ‘বাংলাদেশ’ এর গর্বিত নাগরিক। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ প্রাচীন গৌড় বা বরেন্দ্রী বা হরিকেল বা বঙ্গ বা বঙ্গাল দেশ নিয়ে গঠিত।
প্রাচীনকালে বাংলার বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজ নিজ সংস্কৃতি নির্ভর ছিল। যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রও ছিল প্রকট। কিন্তু সংস্কৃতি সব সময় ঐতিহ্য নির্ভর হয়ে থাকে। যেসব গুণ পূর্বসূরি থেকে উত্তরসূরির কাছে হস্তান্তরিত হয়, তাই ঐতিহ্য।
অন্যদিকে সংস্কৃতি চলমান, এর গতি কখনো ধীর, কখনো তীব্র। নতুন নতুন উপাদান পুষ্ট হয়ে ক্রমবিবর্তন ধারায় সংস্কৃতি নব অবয়ব লাভ করে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ‘বাং’ বা ‘বাঙালী’ গোষ্ঠীতে একাত্ম হলেও, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যেও ‘বাং’ বা ‘বাঙাল’ জাতির সংস্কৃতি ও জীবনধারার মাঝে এমন কতগুলো দিক আছে, যা আমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে।
ধারণা করা হয়, প্রাচীন বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠে আমাদের লোকজ ভুবন। পরবর্তীকালে পরিবর্তনের বহমান ধারায় সক্রিয় থেকে ধর্মীয় খোলস পরিবর্তিত হয়ে বাঙালী সংস্কৃতি একটি নিজস্ব রূপ ধারণ করে — যা আমাদের মূল বাঙালী সংস্কৃতির লোকজ ধারা হিসেবে আজো দেদীপ্যমান।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মাকে জানতে হলে আমাদেরকে এই ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি চর্চার গভীরে নিমগ্ন হতে হবে। জীবন অনুশীলনই হলো সংস্কৃতি। জীবন বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি অপ-সংস্কৃতির নামান্তর। সংস্কৃতির মাঝে জীবন-চর্চার বিভিন্ন উপাদান একীভূত হয়ে একে করে সমৃদ্ধ। লোকজ সংস্কৃতিই হচ্ছে একটি জাতির প্রকৃত সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির অন্তরালে থাকে জাতির আদি-মানুষের চিন্তা-ভাবনা, মূল্যবোধ, জীবনাচার, সংস্কার-বিশ্বাস সবকিছু।
বর্তমান ডিস- সংস্কৃতি, বিদেশী সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি আমাদের যেভাবে গ্রাস করছে, ভয় হয় কখন না জানি তা আমাদের শেকড় উপড়ে ফেলে। যান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধায় অভ্যস্ত মানুষ আজ মুহূর্তে মুহূর্তে ধারণা, বিশ্বাস, আর মত পাল্টাচ্ছে। কোন কিছু নিয়ে ভাবনা বা চিন্তা করতে তাদের আজ চরম অনীহা।
কোন কিছুকে তারা আজ বেশি সময় আঁকড়ে থাকতে রাজি নয়। তাদের অনেকেই আজ দেশজ শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির নান্দনিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। অথচ আমাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতি; যে লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদানের ভেতর লুকিয়ে আছে আমাদের বাঙালী জাতির শেকড়ের পরিচয়।
আমাদের জারি, সারি, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, হ্ললা, যাত্রা, লোককাহিনী, রূপকথা, পাঁচালী, কবিগান, চর্যাপদ, পটের গান, দেহতাত্ত্বিক লোক সঙ্গীত, লোকজ ছড়া, লোকগীতি, মাইজভাণ্ডারী, ভাওয়াইয়া, রামলীলা, কৃষ্ণলীলা, পালা, কীর্তন-ভজন, শরীয়ত-মারফত, কারবালা কাহিনী, নবী কাহিনী, পুঁথিপাঠ, হস্ত ও কারুশিল্প, গ্রামীণমেলা, লোকজ উৎসব ইত্যাদি পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা লোকজ সম্পদ আমাদের শেকড়ের আসল ঠিকানা। হাজার বছরের পুরনো লোকজ উপাদানগুলো আমাদের অহংকার, অতীত-বর্তমানের সেতুবন্ধন।
আমাদের গ্রামীণ মেলাগুলোর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশের হৃদয়। গাঁও- গেরামের নিরক্ষর গায়েনের দোতারার টুং টাং মূর্ছনার পাশাপাশি লোকনৃত্য, লোক খেলাধুলা, লোক নাটক, যাত্রা ইত্যাদির সমন্বয়ে একেকটি মেলায় জমে উঠে গ্রামীণ মানুষের পরাণের গহীনের একান্ত উৎসব, লোকজ উৎসব। আধুনিকতার জোয়ারে এসব মেলা-উৎসবের ধারাবাহিকতার রূপান্তর ঘটলেও এসবের শিকড় কিন্তু আজো গ্রামেই প্রোতিত।
চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের ওরশের মেলা, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথধাম শিবচতুর্দশী মেলা, কক্সবাজারের মহেশখালী আদিনাথ মেলা, বরিশালের বানারীপাড়ার বেতাল গ্রামের ‘সূর্যমণির মেলা’, রাঙ্গামাটির দিঘিনালা বৌদ্ধমেলা, শরীয়তপুরের নড়িয়া ‘সুরেশ্বর মেলা’, ফরিদপুরের বালিয়াকান্দি ‘হরিঠাকুরের মেলা’, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের ‘দোল মেলা’ ও ‘ধলমেলা’, দিনাজপুরের কাহারোল ‘নেকমদ’ মেলা, চট্টগ্রামের রাউজানের মহামনি মেলা ইত্যাদি বাংলাদেশের প্রাচীন গ্রাম-সমাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এসব মেলা- উৎসবের ভিতর লুকিয়ে আছে প্রকৃত গ্রাম-বাংলার আসল রূপ। আবহমানকাল ধরে গ্রাম-বাংলার অস্থি-মজ্জার সাথে মিশে আছে লোক-সংগীত, লোক-গাঁথাগুলো। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ও সুরারোপিত লোক- সংগীত, লোক-গাঁথাগুলো পুরুষ পরম্পরাক্রমে আমাদের হস্তারিত সম্পদ। আধুনিক শহুরে সংস্কৃতির সর্বনাসা কালস্রোতও এ ঐতিহ্যে ভাটা আনতে পারেনি।
কারণ লোকসংগীত অনুভূতিপ্রধান হলে, যা লোকচিত্তে সাড়া দেয়—তাই লোক সংগীতে গৃহীত হয়। লালন শাহ, হাছন রাজা, সিরাজ সাঁই, দুন্দু শাহ, পাগলা কানাই, কদলী পা, গোসাই অনুকূল, মদন ফকির, রকীব শাহ, মনসুর শাহ, হরেন বাউল, কালু শাহ ফকির, হাউড়ে গোসাই, শরৎ বাউল, গগণ হরকরা, আরকুম শাহ, নবীন সাধু, আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীম, রমেশ শীল, শেফালী ঘোস, আবদুর রহমান বয়াতী, কুদ্দুস বয়াতী, কাঙ্গালিনী সুফিয়া লোক সংগীতের কালোত্তীর্ণ শিল্পী।
এদের কণ্ঠ, গানের বাণী ও সুর হৃদয় ছোঁয়া। আধুনিক গানের বা রিমিক্সের দাপটে যেন আমাদের সমৃদ্ধ লোক সংগীত হারিয়ে না যায়, তজ্জন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের লোক- সাহিত্যের বেশিরভাগই কাব্যগাঁথা বা লোক-সংগীত, এর যেটুকু গদ্য তা কেচ্ছা-কাহিনী বা রূপকখা। লোক সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিকতার প্রভাব অপরিসীম। ড. আহমদ শরীফ, অজয় রায়ের ‘বাংলা ও বাঙ্গালী’ বইয়ের ভূমিকায় বলেন, ‘আঞ্চলিক মন, মনন ও সংস্কৃতির স্পষ্ট ছাপ আজো জীবনের সব ক্ষেত্রে বিদ্যমান। সাহিত্য ক্ষেত্রে এ আঞ্চলিকতা বিস্ময়করভাবে সুপ্রকট।
যেমন ধর্মমঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল হয়েছে রাঢ অঞ্চলে, মনসামঙ্গল হয়েছে পূর্ববঙ্গে, বৈষব সাহিত্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে; বাউল প্রভাব পড়েছে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে। সত্যপীর বা সত্য নারায়ণকেন্দ্রী উপদেবতার প্রভাব-প্রসার ক্ষেত্র হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে। গীতিকা হয়েছে ময়মনসিংহ-চট্টগ্রামে, মুসলিম রচিত সাহিত্যের বিশেষ বিকাশ ঘটেছে চট্টগ্রামে।’
লোক সাহিত্যের একটি বিশেষ গুণ হল তার স্বাভাবিক ব্যঞ্জনা- যা এর শ্রোতা বা পাঠককে আকর্ষিত করতে পারে। প্রাচীন লোক-নৃত্যে নৃত্যের তালে তাল মিলাতে গিয়েই লোক-সংগীত নাট্যরূপ লাভ করে। কবি গান, জারি গানে সামান্য হলেও নাটকীয়তা দৃষ্ট হয়। গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য পরিবেশনের রেওয়াজও সুপ্রাচীনকালের।
হাজার বছরের বাংলা নাটকের লুপ্ত-প্রায় ইতিহাসের শেকড় সন্ধানে নিবিষ্ট হলে উঠে আসবে অনেক অজানা তথ্য। বাংলাদেশের ভৌগোলিক-আঞ্চলিক ও প্রাকৃতিক প্রভাব, নদীবিধৌত পরিবেশ—- এ অঞ্চলকে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্টতা দান করেছে; যা জাতি হিসেবে আমাদের আপন স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত এবং যা আমাদের জাতিসত্তাকে করেছে উর্বর ও গৌরবদীপ্ত। একদিনে তা হয়নি, হাজার বছরের বিবর্তনে তা বহমান রূপ পরিগ্রহ করে।
নরসিংদীর উয়ারী ও বটেশ্বর এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার চন্দ্রকেতুগড় বাংলার ইতিহাসকে খ্রীষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর পূর্বে নিয়ে যায়। অতএব আমরা শেকড়হীন নই, আমাদের রয়েছে সুদৃঢ় শেকড়। আসুন আমরা এখনই শেকড়ের সন্ধানে নিবিষ্ট হই।