ভোরে লোকালয়ের ঘাট ছাড়ে ডিঙি। চারজন জেলের সঙ্গী হয়েছি। তাঁদের কাছ থেকে বনজীবনের গল্প শুনি। শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর মোহনা পেরিয়ে ঘণ্টাখানেক পর ফুলতলা খালে পৌঁছাই। দুই পাশে ঘন বন। ভাটার টানে জায়গায় জায়গায় চর জেগেছে। সকালের স্নিগ্ধতায় হরিণ ও বন্য শূকরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে, দৌড়ঝাঁপ করছে বানরের পাল।
আরও ২০ মিনিট খালটি ধরে আগাতেই বড় একটি ‘দোয়া’য় এসে পড়লাম। দোয়া মানে কয়েকটি খালের মিলনস্থল। সেখান থেকে খালে ঢুকে পড়ি। এভাবে আরও কয়েকটি খাল, বাঁক পেরিয়ে হাতের ডানে পড়ল জয়মনির খাল। খালের আগার দিকে যাব আমরা। যত সামনে আগাই সরু হতে থাকে জয়মনির খাল। খালের পাড়ের কেওড়াগাছভর্তি ফল। পাতার চেয়েও বেশি কেওড়া।
আকাশে মেঘ জমেছিল। শুরু হয় বৃষ্টি। নৌকায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকি। কিন্তু ভিজে একশা। আধঘণ্টার মতো টানা বৃষ্টি হয়ে থেমে যায়। চারপাশে আবার ঝকঝকে রোদ। গাছের পাতাগুলো চকচক করছে। এর মধ্যেই নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে জাল বের করেন আবদুর রহমান। চিংড়ি ধরার ঝাঁকি জাল। জালের ওপর প্রান্তে সরু রশি আর নিচের দিকে লোহার ছোট ছোট কাঠি। যাতে পানিতে জাল ফেললে তাড়াতাড়ি ডুবে যায়। মাছ ধরার সময় রশিটি হাতে রেখে জাল পানিতে ছুঁড়ে মারা হয়। পরে রশি ধরে টেনে জাল তোলা হয়।
নৌকার এক মাথায় বইঠা বেয়ে চলেছেন জেলে আবু মুসা। জয়মনির খালের পাড়ে আমাদের নৌকা থামে। ততক্ষণে ভাটায় অনেকটা পানি নেমে গেছে। নৌকা থেকে লাফিয়ে খালের মধ্যে নেমে পড়েন আবদুর রহমান। পানির মধ্যে নামার ধপাস আওয়াজে বুকের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ‘এখানে তো কুমিরও আছে।’
আমার কথা শুনে হেসে ওঠেন জেলেরা।
আবদুর রহমান হাতের ঝাঁকি জাল খালে ছুড়ে মারেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর জাল টানতে থাকেন। জাল ভরে ওঠে বড় বড় চাকা চিংড়ি। নৌকার মাথায় দাঁড়িয়ে খালের মাঝখানে আরেকটি জাল ফেলেন জেলে আবু মুছা। ধীরে ধীরে জালের ওপরের প্রান্তে সরু রশি টেনে নৌকার ওপরে জাল তুলতেই দেখা যায় দাতিনা, পারশে আর চিংড়ির ঝাঁক। মাছগুলো ছাড়িয়ে নৌকার খোলে রাখা হয়।
জাল নিয়ে সবাই এবার খালের পাড়ে নেমে যান। আমিও নামি। খালের দুই পাড়ে আবু মুছা ও আবদুর রহমান জাল ফেলছেন আর মাছ কুড়িয়ে ব্যাগে রাখছেন সাফায়ত হোসেনে ও হাবিবুর রহমান। কিছুক্ষণ পরপরই মাছে ব্যাগভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তখন মাছগুলো ব্যাগ থেকে নৌকার মধ্যে ঢেলে রাখছেন।
মাছ ধরতে ধরতে সুন্দরবনের নানা গল্প শুনি। বাঘ, কুমির আর বনদস্যুর গল্প। বাঘগুলো নাকি বেশ চালাক আর হিংস্র। অনেক জায়গায় পানিতে পা রাখলে নাকি কুমির টেনে নেয়। সুন্দরবনের নদী খালের পানিতে নামাও যেমন অনিরাপদ আবার মালে (জঙ্গলে নামা) ওঠাও ঝুঁকির। গল্পের মধ্যেই হঠাৎ বনের ভেতরে কি যেন নড়েচড়ে ওঠে। খট করে একটা শব্দও হয়। মুহূর্তেই সবাই সতর্ক হই। বুকটা ধুকধুক করতে থাকে। গাছের একটি ডাল ভেঙে নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে জঙ্গলে ওঠেন হাবিবুর রহমান। মিনিট খানেক পরে ফিরে এসে বলেন, ‘জংলি শূকর!’
ভাটার টানে দ্রুত নেমে যাচ্ছে খালের পানি। একেবারে শুকিয়ে গেলে নৌকা বের করা যাবে না। দ্রুত নৌকায় ওঠার তাড়া দিতে থাকে আবু মুছা। সবাই মিলে জাল গুটিয়ে নৌকায় ফিরি। পাটাতন মাছে ভরে আছে।
আর দেরি না করে ফিরতি পথ ধরি আমরা। এ দিকে আসতেই জোয়ার শুরু হয়। জয়মনির খাল থেকে বেরিয়ে ফুলতলা খালের মধ্যে মাছের ঝাঁক দেখলাম। খালের পাড়ে যেখানে দুই ঘণ্টা আগেও শুকনা ছিল, সেখানে এখন হাঁটুপানি। জোয়ার আসার পর সারা গা কামড়াতে থাকে এক ধরনের ছোট পোকা। সাফায়ত বললেন, ‘এর নাম বাইড়ে পোকা। জঙ্গলে চলতে গেলে, থাকতে গেলে এ পোকার কামড় মেনে নিয়ে চলতে হয় ভাই। জোয়ারের সময় জঙ্গল আর কাঁদা থেকে বেরিয়ে আসে পোকাগুলো। কামড়ে প্রচণ্ড চুলকায় শরীর।’
খালের মধ্যে এক ফোঁটা বাতাস নেই। কিন্তু জোয়ারে চারপাশে খলবল করছে পানি। পানিতে একাকার সুন্দরবনের খাল, নদী আর ডাঙা। নৌকায় ভেসে ভেসে লোকালয়ের পথে চলেছি আমরা।
ইমতিয়াজ উদ্দীন, সৌজন্য : প্রথম আলো