লালন শাহের মরমী দর্শনঃ
লালন শাহ ঊনিশ শতকের দার্শনিক কবি। বাংলা সাহিত্যে আধুনিককালে হলেও, মানসিক দিক থেকে লালন ছিলেন মধ্য যুগের। লালন চিন্তা মানসে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্মের পার্থক্য ছিল না। তার সম্পর্কে এ ধরনের প্রশ্ন তুললে তা প্রাসঙ্গিক হবে না। ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর চিন্তাধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ পেয়েছে সঙ্গীতে। সঙ্গীত তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের ভান্ডার। লালন-মানসে ছিল গভীর তত্ত্বজ্ঞান। লালন শাহের দর্শনকে বলা হয় মরমী দর্শন। আপন হৃদয়ে পরম-সত্তাকে অপরোক্ষ অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধিকারী সাধকরা সাধারণত মরমী সাধক নামে পরিচিত। পরম-সত্তার সাথে অব্যবহিতভাবে একাত্বতার অনুভব করার নামই মরমীবাদ। পরম-সত্তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য মরমী দার্শনিকরা আধ্যাত্মিক চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন।
লালন শাহের মতে, মানুষের এসেন্স বা অন্তঃসার তার দেহেই নিহিত। মরমী দর্শনের মূলকথা আত্মতত্ত্ব। তাঁর দর্শনে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে কোনো প্রভেদ করা হয় না। দেহ সাধনার মধ্য দিয়েই পরমাত্মার সাধনা করা যায়। দেহের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় পরম স্রষ্টাকে। লালন আত্মতত্ত্ব সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তাঁর এ সাধনার অভিক্যক্তি ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন গানে। লালন নিজেকে নিজেই সম্বোধন করে বলেনঃ
“ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর ঘরের খবর
যাবি কোথায়?
আপন ঘর না বুঝে বাইরে খুঁজে
পড়বি ধাঁধায়।
লালন মানবসত্তার মূলতত্ত্বে যাবার প্রেরণা পান আত্মতত্ত্ব থেকে। তিনি পার্থিব মানব অভ্যন্তরে আবিষ্কার করেছেন অপার্থিব মানবসত্তা। এ সম্পর্কে তাঁর গানে ধ্বনিত হয়েছেঃ
এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ-রতন।
এখানে আত্মতত্ত্বই প্রকাশিত হয়েছে। সুফীতত্ত্ব ও ভারতীয় দর্শনে ‘আত্মনং বিদ্ধি’ (আত্মাকে জান) বলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বলা যায়, লালন শাহ স্পষ্টভাবে ‘মানুষ-রতন-তত্ত্ব’ প্রকাশ করেছেন।
আত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধ শুধু লালনের আত্মদর্শনেই নয়, দেহতত্ত্বেও এর প্রকাশ আছে। দেহসাধনার মধ্য দিয়েই অনুসন্ধান করতে হবে বিশ্ববিধাতাকে। এ সম্পর্কে লালনের সুপ্রসিদ্ধ গান আজও বাংলার ঘরে ঘরে গীত হয়ঃ
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখী মেনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।
আট কুঠরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা,
তাহার উপর আছে সদর-কোঠা
আয়না মহন তায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কয়, খাঁচা খুলে
সে পাখী কোন খানে পালায়।”
পরম-সত্তাকে জানার জন্য মরমী সাধকরা চিরকাল বেরিয়েছেন। লালন শাহ এ পরম-সত্তাকে খুঁজেছেন সারাজীবন। তিনি দেহের মধ্যেই পরম-সত্তার সম্ধান করেছেন। তিনি সকল দেশের সকল মানুষের জন্য অতলস্পর্শী সত্যের অনুসন্ধান করেছেন। নিজের মধ্যেই তিনি পরম-সত্তা, পরম-পরিুষের সন্ধান করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
আমার আপন ঘরের খবর হয় না
একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।।
এ পরম-সত্তা প্রকাশ পেয়েছে বাউলের মনে মানুষ তত্ত্বে। এই মনের মানুষকে জানতে পারলেই নিজেকে জানা যায়। পারম-সত্তা বা পরম-পুরুষকে জানা যায়। কিন্তু একে জানা এত সহজ ব্যাপার নয়। তাকে ধরতে হেলে সে ধরা দেয় না। এই আত্মস্বরূপ সাধনার দুর্বোধ্য ইঙ্গিত আছে লালন শাহের গানে। তিনি বলেছেনঃ
কে কথা কয় রে। দেখা দেয় না
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনমভর মেলে না।
এই মনের মানুষকে দেখার কোনো উপায় নেই। কেননা খালি চোখে একে দেখা যায় না। একে উপলব্ধি করা যায় অন্তরের আলোকে। লালন শাহ ও অন্যান্য মরমীবাদীরা একথাই স্পষ্ট করে বলেছেন।
মনের মানুষ বা আত্মা আমাদের দেহেই বিরাজমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও আত্মাকে জানা এত সহজ নয়। দেহে বিরাজিত আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য সাধকরা যুগ যুগ ধরে সাধনা করেছেন। তাই লালন বলেছেনঃ
এই মানুষে সেই মানুষ আছে,
কত মুনি ঋষি চার যুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে।।
পরম-সত্তাকে জানার প্রয়াস যুগ যুগ ধরে অব্যাহত আছে। এ প্রচেষ্টা চলছে নিরন্তর। না-জানাকে অতিক্রম করার জন্য সাধক কি চেষ্টাই না করে চলেছেন। হার মানতে চায় না। মানবাত্মারূপী পাখির সঠিক পরিচয় জানতেই দুঃসহ মর্মবেদনা। লালন শাহ বলেছেনঃ
হায় চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখী
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায়
ঐ খেদে ঝরে আঁখি।।
আত্মাকে তিনি তুলনা করেছেন পাখির সাথে। পাখির সাথে পরমাত্মার অভেদ থাকলেও সে এই মানব দেহে চিরস্থায়ীভাবে বাস করে না। পাখিরূপ আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন হওয়া দরকার। এই মিলনের জন্যই লালন সাধনা করার কথা বলেছেন। খাঁচার পাখি মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের কৌশলও লালন শাহের গানে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
পাখী বসে থাকে খাঁচাতে,
আছে নয় দরজা তাতে,
যায় আসে সে কোন পথে
আমায় দিয়েরে ভেল্কি।।
মানুষের মধ্যে আত্মা আছে, তার রূপ বোঝা কঠিন। মানবদেহে আত্মা বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়। লালন শাহ বলেছেন, এর লীলা বোঝা কঠিন। তিনি বলেনঃ
সেই লীলা বুঝি ক্ষ্যাপা, কেমন করে
লীলার যার নাই সীমা
কোনখানেতে কোন রূপ ধরে।।
মনের মানুষ বা আত্মার ধারণার বিচিত্র লীলা সুফী, বাউল – সকল মরমী দর্শনেই অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের প্রচেষ্টা সাধকের হৃদয়ানুভূতিকে ব্যাকুল করে তোলে। নিজের মধ্যে পরমাত্মার অনুভূতিই মরমী দর্শনকে মহিমান্বিত করেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাব্যে এই হৃদয়ানুভূতির আর্তি লক্ষ্য করার মত।
তাই বলা যায়, বাঙালির দর্শনে লালন শাহ একজন মরমীবাদী দার্শনিক, সাধক। তাঁর দর্শনে আমরা মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের আর্তি লক্ষ্য করি। পরমাত্মার সাথে মিলনের অনুভূতিই তাঁর মরমীবাদী দর্শনকে মহিমান্বিত করেছে।
লালনের দর্শনে আমিত্ব বা আত্মতত্ত্ব বা আত্মাঃ
লালন একজন মরমী সাধক, দার্শনিক। মরমীতত্ত্বের মূলকথা আত্মতত্ত্ব। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘যে নিজেকে জেনেছে বা চিনেছে, সে তার প্রভুকে জেনেছে বা চিনেছে’। তাঁর কথায় ‘ খোদকে চিনলে খোদাকে চিনি’ বা ‘মান্আরাফা নাফ্সাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু।’ আত্মতত্ত্ জ্ঞানলাভের মাধ্যমেই পরমতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করা যায়।
প্রাচীনকালে চার্বাক বা লোকায়ত চিন্তাবিদরা আত্মাকে কোন অলৌকিক আধ্যাত্মবস্তু মনে করত না। তারা মনে করত আত্মা বিভিন্ন বস্তুর সংমিশ্রণজাত। লালনের ভাষায়, ‘আব-আতশ-খাক-বাত’-এর সংমিশ্রণজাত বস্তু মন। প্রাচীনকালের আত্মা সম্পর্কে এই ধারণা কোনো না কোনোভাবে বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া, বাউল প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্য দিয়ে বর্তমানকাল পর্যন্ত চলে এসেছে। এই মতে আত্মা অর্থে মন, মীন, রস, রতি, চন্দ্র, প্রাণ, হৃদয়-বিহারী, আত্মা ইত্যাদি বোঝায়। অতি প্রাচীনকালে যুগল সাধনা পদ্ধতি অনুসরণ করে মন বা আত্মার স্বরূপ লাভের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁরা আত্মা কি তা সঠিকভাবে বলেন নি। লালন বলেনঃ
সবে বলে প্রাণ-পাখী
শুনে চুপে চুপে থাকি
জল কি হুতাশন, মাটি কি পবন,
কেউ বলে না এটা নির্ণয় করে।
লালন বলেন আত্মা মানবদেহেই আছে। কিন্তু তা দেখা যায় না, কথা বলে না। এ সম্পর্কে তাঁর গানে বলা হয়েছেঃ
কে কথা কয় রে। দেখা দেয় না
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনমভর মেলে না।
প্রচলিত অর্থে আত্মা বলতে অধ্যাত্মবস্তু বোঝায়। কিন্তু বৌদ্ধ দার্শনিকরা তা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, আত্মা কতগুলো চির পরিবর্তনশীল মানসিক সংবেদন প্রবাহের সমষ্টি। আধ্যাত্মিক স্থায়ী সত্তা বলে কিছু নেই। এ জন্যই বৌদ্ধরা নৈরাত্মবাদী। পাশ্চাত্য দার্শনিক হিউমও আধ্যাত্মিক বস্তু হিসেবে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, “ও হবাবৎ পধহ পধঃপয সুংবষভ ধঃ ধহুঃরসব রিঃযড়ঁঃ ধ ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ, ধহফ হবাবৎ পধহ ড়নংবৎাব ধহুঃযরহম নঁঃ ঃযব ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ.” চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছার সমষ্টিই মন। বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউম প্রমুখ পরিবর্তনশীল মানসিক সংবেদন বা অসার বস্তুকে ‘সার’ মনে করেন। লালনের মতে, ‘আধ্যাত্মিক আত্মা’, ‘রুহ’, পরমাত্মা বা পরমাত্মার বৈশিষ্ট্য এক স্থায়ী ‘আধ্যাত্মিক সত্তার বৈশিষ্ট্য’।
লালন দর্শনে আত্মা বা ‘আমি’ এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। জীবন ও জগতের কেন্দ্র ‘আমি’। এই ‘আমি’ যেমন একদিকে জগতের স্রষ্টা, অন্যদিকে তেমনি ভোক্তা। সকল প্রকার জ্ঞান ও কর্মের মূল আমি। ‘আমি’কে কেন্দ্র করেই মানুষের অন্তর ও বাইরের দিকে অগ্রযাত্রা। ‘আমি’কে জানতে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে চায়। ‘আমি’ বা আত্মার স্বরূপকে উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বৃহত্তর ‘আমি’ বা ‘পরমাত্মা’র উপলব্ধি করতে হয়। এ সম্পর্কে লালন তাঁর গানে বলেছেনঃ
আমি কি তাই জানলে সাধন সিদ্ধি হয়
আমি শব্দের অর্থ ভারি, আমি সে তো আমি নয়।
অন্তর শহর বাজারে
আমি আমি শব্দ করে
আমার খবর নাই আসাতে
— বেদ পড়ি পাগলের প্রায়।
ধর্ম গ্রন্থের বর্ণনার মাধ্যমে ‘আমি’ বা আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই ‘আমি’ একদিকে যেমন আমার ‘আমি’, অন্যদিকে ‘আমি’ সেই ‘পরম আমি’ বা ‘পরমাত্মা’। এই ‘আমি’ বা ‘পরম-সত্তা’ সৃষ্টির মূল কারণ। এ থেকেই সবকিছুর প্রকাশ।
‘আমি’কে উপলব্ধির জন্য গুরুর সাহায্যের প্রয়োজন পরম-সত্তার পরমরূপ নিগূঢ় উপলব্ধির বিষয়। এই উপলব্ধি আধ্যাত্মিক আলোকপ্রাপ্ত জ্ঞানী মুর্শিদের নিকট আছে। গুরুর সংস্পর্শ, গুরুর কৃপায় আত্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব।
এই ‘আমি’ বা পরম-সত্তাকে মরমী সাধকরা চিরকাল খুঁজে বেরিয়েছেন। এই ‘আমি’ উপলব্ধিতেই ‘দেহ ভাণ্ডই সত্যের বাহক। দেহকে বাদ দিয়ে মরমী সাধনা হয় না। যাঁরা মরমী সাধনা না করে “এই দেহের সকল বাতি না জ্বালিয়ে’ দেহকে অন্ধকার করে রেখে আধ্যাত্মিক আত্মার স্বরূপ জানতে চেষ্টা করেন, তাঁরা নিস্ফল প্রচেষ্টা চালান।”
লালন শাহ মনে করেন, দেহের মধ্যে আত্মা, পরমাত্মার বাস। দেহের সাধনা ব্যতীত আত্মার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব নয়। লালন দর্শনে আত্মাকে পাখির সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁর গানে বলা হয়েছেঃ
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখী মেনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।
আট কুঠরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা,
তাহার উপর আছে সদর-কোঠা
আয়না মহন তায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কয়, খাঁচা খুলে
সে পাখী কোন খানে পালায়।”
পাখিরূপ আত্মা দেহে চিরকাল বাস করে না। কারণ, দেহ আত্মার স্থায়ী আবাস নয়। লালন বলেছেন ‘কাঁচা বাঁশে’র তৈরী। এই দেহ ছেড়ে আত্মা যেকোনো দিন চলে যেতে পারে।
আত্মার অবস্থান দেহের ভিতর থাকলেও এর স্বরূপ বোঝা এত সহজ নয়। তাই লালন খেদ প্রকাশ করে বলেছেনঃ
হায় চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখী
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায়
ঐ খেদে ঝরে আঁখি।।
আত্মার স্বরূপ বোঝা কঠিন। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন ঘটে। কিন্তু এই মিলন সহজসাধ্য নয়। এজন্য সাধনার প্রয়োজন। সাধনা ছাড়া মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের উপলব্ধি সম্ভব নয়।
লালন দর্শনে দেখা যায়, এই মানুষের মধ্যে সেই মানুষ বা পরমাত্মার আবাস। আবার পরম-মানুষ বা পরমাত্মাকে পাবার মাধ্যম এই মানুষ। মানুষ বাদে কোনো সাধনা করলে তা বিফলে যাবেই। এ সম্পর্কে লালনের গানে বলা হয়েছেঃ
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুল মূল হারাবি।।
দ্বিদলে আর মৃণালে
সোনার মানুষ উজলে
মানুষ-গুরুর কৃপা হলে
জানতে পাবি।
গাছে যেমন আলেকলতা,
এই মানুষে মানুষ গাঁথা
জেনে শুনে মুরাও মাথা
যাতে ত্বরবি।
মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই ঘোর আঁধার,
লালন বলে মানুষ-আকার
ভজলে পাবি।
লালন দর্শনে ‘মানব সেবা’ সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত হয়েছে। মানুষের মধ্যে উত্তম সত্তা বর্তমান। এটাই লালন দর্শনে ‘মানুষ-রতন’। এখানে এই মানুষকেই বলা হয়েছে ‘সোনার মানুষ’। এই সোনার মানুষ হতে হলে ‘মানুষ ভজন’ করতে হবে। মানুষের জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য। এর চেয়ে বড় কিছু নাই।
মানুষের মধ্যে যে আত্মা আছে তার স্বরূপ বোঝা কঠিন। মানব দেহে আত্মা বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়। লালন শাহ বলেছেন, এর লীলা বোঝা কঠিন। তাঁর গানে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
সেই লীলা বুঝি ক্ষ্যাপা, কেমন করে
লীলার যার নাই সীমা
কোনখানেতে কোন রূপ ধরে।।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মনের মানুষ বা আত্মার ধারণার বিচিত্র লীলার পরিচয় পাওয়া যায় বাউল, সুফী দর্শনে। আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের প্রচেষ্টা সাধকের হৃদয়ানুভূতিকে ব্যাকুল করে তোলে। নিজের মধ্যে পরমাত্মার অনুভূতিই মরমী দর্শনকে মহিমান্বিত করেছে। লালনের গানে এ হৃদয়ানুভূতি উপলব্ধি করার মত।
[ডক্টর রামদুলাল রায়, বাঙালির দর্শন ঃ প্রাচীনকাল থেকে সমকাল, একাদশ অধ্যায় ঃ লালন শাহের দর্শন, পৃঃ ১৭৯-১৮৮]