এমন একটা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে, রবীন্দ্রনাথই লালনচর্চার পথিকৃৎ এবং বাঙলার বিদগ্ধ-সমাজে তিনিই প্রথম লালনকে পরিচয় করিয়ে দেন। এই জনপ্রিয় ধারণাটি পরীক্ষিত হলে দেখা যাবে বক্তব্যটি অর্ধসত্য মাত্র। রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালনের গানের উল্লেখ করেন ভাদ্র ১৩১৪ সালে, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে। এই একই গানের প্রথম দুটি পংক্তির উল্লেখ মেলে ‘জীবন-স্মৃতি (১৩১৯)’ গ্রন্থের ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ অধ্যায়ে। এরপর ১৩৩২ সালে ‘ভারতীয় দার্শনিক সংঘে’র সভাপতির ভাষণেও এই ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কম্নে আসে যায়’ গানের উল্লেখ করেন।
শিলাইদহে জমিদারী পরিচালনাকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় রক্ষিত খাতা থেকে লালন ফকিরের ২৯৮টি গান নকল করিয়ে আনেন। ১৩২২ সালের আশ্বিন থেকে মাঘ পর্যন্ত চার কিস্তিতে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘হারামণি’ বিভাগে রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত লালনের মোট ২০টি গান প্রকাশিত হয়। এরপর ১৩৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত ‘ছন্দের প্রকৃতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে, যা পরে ‘ছন্দ’ গ্রন্থে ভুক্ত হয়, রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের ৩টি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে এর ছন্দ-সুষমা সম্পর্কে সপ্রশংস মন্তব্য করেন। এছাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ লালনের গানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, এর শিল্পগুণ ও দর্শন কবিকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর বাউলাঙ্গের গানেও লালনের প্রভার দুর্লক্ষ্য নয়।
‘রবীন্দ্রবাউল’ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করার প্রেরণাও অনেকাংশে এসেছিল লালন ফকিরের নিকট হতেই। এই হলো রবীন্দ্রনাথের লালনচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। লক্ষ্য করা যাবে, রবীন্দ্রনাথ লালনের নামোল্লেখ না করে তাঁর একটি প্রাতিস্বিক গানের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন ভাদ্র ১৩১৪ সালে এবং লালনের পূর্ণাঙ্গ গান প্রথম প্রকাশ করেন ১৩২২ সালের আশ্বিন মাসে (রবীন্দ্রনাথের লালনচর্চার আনুপূর্বিক বিবরণের জন্য দ্র. রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর গ্রন্থ ‘কয়েকজন লোককবি এবং প্রসঙ্গত’, ঢাকা, ১৩৯১)।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বহু পূর্বেই একাধিক লোকসংস্কৃতি-অনুরাগী সাহিত্যসেবী লালনের গান ও জীবনী সংগ্রহ ও প্রচার করেন এবং তাঁদের লালনচর্চা, সীমিত ক্ষেত্রে হলেও বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে যাঁরা লালনচর্চায় অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, রাইচরণ দাস, জলধর সেন, অক্ষরকুমার মৈত্রেয়, সরলা দেবী, আবদুল ওয়ালী, দুর্গাদাস লাহিড়ী, অনাথকৃষ্ণ দেব, কুমুদনাথ মল্লিক, মীর মশাররফ হোসেন, সতীশচন্দ্র দাস, করুণাময় গোস্বামী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
লালনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত ও মীর মশাররফ হোসেন পরিচালিত ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় (৩১শে অক্টোবর, ১৮৯০)। ধারণা করা হয় এই নিবন্ধের রচয়িতা ছিলেন ‘হিতকরী’র সহ-সম্পাদক কুষ্টিয়ার উকীল রাইচরণ দাস। এই নিবন্ধে লালনের জীবনীসহ একটি গান প্রকাশিত হয় (দ্র. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত ‘লালন স্মারকগ্রন্থ’, ঢাকা, ১৯৭৪)। মীর মশাররফ হোসেনের ‘সঙ্গীত লহরী’র (১৮৮৭) একটি গানেও লালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। জলধর সেন তাঁর ‘কাঙ্গাল হরিনাথ’ (১ম খণ্ড ঃ ১৩২০) গ্রন্থে লালন ফকিরের প্রেরণাসঞ্চারী ভূমিকার উল্লেখসহ একটি গান উদ্ধৃত করেন। সরলা দেবী ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩১২ সালের ভাদ্র সংখ্যায় ‘লালন ফকির ও গগন’ নামীয় প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ তাঁর গান প্রকাশ করেন।
দুর্গাদাস লাহিড়ীর ‘বাঙালীর গান’ (১৩১২) ও অনাথকৃষ্ণ দেবের ‘বঙ্গের কবিতা’ (১৩১৮) গ্রন্থে লালনের গান ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি সংকলিত হয়। কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’তে (১৩১৭) লালনের পরিচিতসহ গান প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই ‘প্রবাসী’র ‘হারামণি’ বিভাগে সতীশচন্দ্র দাস (আষাঢ় ১৩২২) ও করুণাময় গোস্বামী (ভাদ্র ১৩২২) লালনের গান প্রকাশ করেন। তবে লালনচর্চায় পথিকৃতের মর্যাদা কুমারখালীর সাহিত্যসাধক কাঙাল হরিনাথ মজুমদারেরই (১৮৩৩-১৮৯৬) প্রাপ্য। রবীন্দ্রনাথের লালনচর্চার প্রায় অর্ধ-শতক পূর্বেই কাঙাল হরিনাথ লালন সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
লালন ফকিরের সাথে কাঙাল হরিনাথের ঘণিষ্ঠ পরিচয় ছিল। এই দুই মরমী সাধকের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। লালন মাঝে মাঝে আসতেন কুমারখালী কাঙাল-কুটিরে। কাঙাল যেতেন ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়ায়। কাঙাল বাউল গান রচনায় লালনের দ্বারাই উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁর ‘ফিকিরচাঁদের বাউল দল’ গঠনের পেছনেও ছিল লালনের প্রেরণা। এ সম্পর্কে জলধর সেন তাঁর কাঙাল জীবনীতে উল্লেখ করেছেন।
কথিত আছে, কাঙাল একবার তাঁর রচিত বাউল গান লালনকে দেখতে দিলে তিনি মন্তব্য করেন, এই ব্যঞ্জন ভালই হয়েছে তবে লবণ কিঞ্চিৎ কম, অর্থ্যাৎ ভাষা নীরস হয়েছে (দ্র. বসন্তকুমার পালের গ্রন্থ ‘মহাত্মা লালন ফকির’, নদীয়া, ১৩৬২)। কাঙালের অনেক গানেই লালনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে জাতিত্বের পরিচয়-জ্ঞাপক গানগুলিতে। কাঙালের বিপদের দিনেও লালন ছিলেন তাঁর একান্ত সহায়। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় প্রজাপীড়নের সংবাদ প্রকাশের কারণে শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদাররা যখন কাঙালকে নানাভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত করতে প্রয়াসী হন, লাঠিয়াল কিংবা পাঞ্জাবী গুণ্ডা নিযুক্ত করেন, তখন লালন ফকির তাঁর শিষ্য সম্প্রদায়কে নিয়ে কাঙালকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন এবং তাঁর শিষ্যরা কাঙালের নিরাপত্তার জন্য জান কবুল করেন। কাঙাল নিজেই সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতায় তাঁর অপ্রকাশিত ‘দিনলিপি’তে এর বিবরণ লিখে গেছেন।
লালনচর্চার উদ্বোধক হিসেবে কাঙাল হরিনাথের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। তিনি ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ও অপ্রকাশিত ‘দিনলিপি’তে লালনের উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর গান প্রকাশ করেছেন। তাঁর ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’ (১ম ভাগ ১ম সংখ্যা ঃ ১২৯২) গ্রন্থে তিনি লালনের একটি গান উদ্ধৃত করেছিলেন এবং এই গানটির সুরে বাঁধা তাঁর কয়েকটি গানের উল্লেখ করেছিলেন। এই ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’-এই (২য় ভাগ ১ম সংখ্যা) পাওয়া গেল লালনের অতি সংক্ষিপ্ত একটি পরিচিতি। হরিনাথ তাঁর অপ্রকাশিত ‘দিনলিপি’তে তাঁর বিপন্ন সময়ের বন্ধু লালনের কথা উল্লেখ করেছেন। কাঙালের পূর্বে লালনের উল্লেখ আর কোথাও কেউ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় (১০ম ভাগ ১৭ সংখ্যা ঃ ভাদ্র ১ম সপ্তাহ, ১২৭৯ ঃ আগস্ট ১৮৭২; পৃঃ ৩) ‘জাতি’ শীর্ষক একটি সংবাদ নিবন্ধে লালন ফকিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘গ্রামবার্ত্তা’য় প্রায় সব সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও সংবাদ নিবন্ধই কাঙাল হরিনাথ রচনা করতেন। তাই অনুমান করা যায় এই সংবাদ-নিবন্ধটির রচয়িতাও হরিনাথ নিজেই। অবশ্য এখানে নিবন্ধকার লালন সম্পর্কে আলোচনার জন্য এই নিবন্ধ রচনা করেন নি, প্রসঙ্গক্রমে লালনের কথা উচ্চারিত হয়েছে এবং লক্ষ্য করা যাবে নিবন্ধকারের মন্তব্য লালনের অনুকূলে ছিল না। ‘গ্রামবার্ত্তা’র নিবন্ধকার লিখছেনঃ
“…. সকলেই ব্রাহ্ম ও ধর্মসভার নাম শুনিয়াছেন। গৌরসভা নামে নিুশ্রেণীর লোকরা আর এক সভা স্থাপন করিয়াছে। ইহার নির্দিষ্ট স্থান নাই। গৌরবাদী বক্তা এক পল্লীগ্রামে উপস্থিত হইয়া, সভা করিয়া গৌরাঙ্গের চরিত ও লীলাদি বর্ণনা করে, স্ত্রী-পুরুষে ৩/৪ শত লোক এক সভায় উপস্থিত থাকে। ইহারা স্বধর্ম্মের মধ্যে, জাতিভেদ স্বীকার করে না, কুধি, কামার, কুমার, তেলি, জালিক, ছুতার প্রভৃতি সকলেই এক সঙ্গে আহার করে। এই দলে মুসলমান আছে কি না জানিতে পারা যায় না। লালন শাহ নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম্ম আবিষ্কার করিয়াছে।
হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। ইহারা যে জাতিভেদ স্বীকার করে না সে কথা বলা বাহুল্য। এখন পাঠকগণ চিন্তা করিয়া দেখুন, এদিকে ব্রাহ্মধর্ম্ম জাতির পশ্চাতে খোঁচা মারিতেছে, ওদিকে গৌরবাদীরা তাহাতে আঘাত করিতেছে, আবার সে দিকে লালন সম্প্রদায়িরা, ইহার পরেও স্বেচ্ছাচারের তাড়না আছে। এখন জাতি তিষ্ঠিতে না পারিয়া, বাঘিনীর ন্যায় পলায়ন করিবার পথ দেখিতেছে।”
প্রসঙ্গক্রমে অতি সংক্ষেপে লালন সম্পর্কে এখানে মন্তব্য করা হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য ও সিদ্ধান্ত এই নিবন্ধ থেকে পাওয়া যায়। যেমনঃ
এক. লালন শাহ কায়স্থ-সন্তান ছিলেন।
দুই. হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই লালন-মতবাদে দীক্ষিত হন।
তিন. ১৮৭২ সাল নাগাদ লালন সম্প্রদায় বিশেষ ‘প্রবল’ হয়ে ওঠে এবং সমাজে তাঁদের একটা বড় প্রভাব গড়ে ওঠে।
চার. লালনপন্থীরা জাতিভেদ প্রথার বিরোধী ছিলেন।
পাঁচ. লালনপন্থীদের ক্রমবিবর্ধনে শাস্ত্র-আচার সচেতন সনাতন হিন্দু সমাজ বিশেষ চিন্তিত হয়ে উঠেছিল।
ছয়. লালন সম্পর্কে নিবন্ধকার কাঙাল হরিনাথ মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা’য় বিশদ আলোচনার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন।
এভাবে আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর পূর্বে কাঙাল হরিনাথ লালনচর্চার সূচনা করেন। সেই হিসেবে বলা চলে ‘গ্রামবার্ত্তা’ পত্রিকার আগস্ট ১৮৭২ সালের এই লালন সম্পর্কিত প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন তথ্য এবং লালনচর্চার প্রথম নিদর্শন।
ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী