ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

বাঙালির শেকড়

ভারত প্রাচীন সভ্যতার একটি দেশ। প্রস্তরযুগে এখানে গড়ে ওঠে অত্যন্ত উঁচুস্তরের উন্নত এক সংস্কৃতি যা পরবর্তী বিকাশের ক্ষেত্রে সমগ্রভাবে প্রাচ্যের, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ও দূর প্রাচ্যের বহুজাতির সংস্কৃতির অগ্রগতিতে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। খননলব্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মানবসমাজের আদিমতম কাল থেকে ভারতে জনবসতি ছিল।
উচ্চতর ভূ-স্তরের প্রত্নপ্রস্তর যুগে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারা সূচিত হয়েছিল। বর্তমানে আমরা যাদের ‘হোমোস্যাপিয়ান্স’ বা নৃ-গোষ্ঠী বলে জানি তাদের প্রথম উদ্ভব ঘটে এই যুগে।

“প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে উচ্চতর প্রত্নপ্রস্তর যুগে ভারতে প্রাধান্য ছিল নিগ্রো-গোত্রীয় জনগোষ্ঠীর, পরে মধ্যপ্রস্তর যুগে পশ্চিম ভারতে আবির্ভূত হয় ককেশীয় ও পূর্ব ভারতে মঙ্গোলীয় গোত্রের নৃগোষ্ঠী।” ১

পশ্চিমবঙ্গের বীরভাবপুর থেকে আবিস্কৃত প্রত্ন নিদর্শন থেকে জানা গেছে মধ্যপ্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে মানববসতি ছিল। তবে ভারত একটি বিশাল দেশ বিধায় এর বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল অসমান গতিতে।

নবপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে দুটি সুস্পষ্ট আঞ্চলিক ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে একটি হল বিহার-উড়িষ্যার এবং অপরটি আসামের ধারা। বঙ্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল ব্যাপী ছিল বিহার-উড়িষ্যার ধারাটির প্রভাব। আসামের ধারাটিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নবপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতিগুলোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে বিহার –উড়িষ্যার সাংস্কৃতিক ধারার গোড়ার দিকে স্থানীয় বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রাধান্য লাভ করে। ভারতের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণের অঞ্চলগুলোতে যখন নবপ্রস্তর ও গোড়ার দিককার তাম্রপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতিগুলো বিকশিত হয়ে ওঠছিল তখন সিন্ধু উপতক্যায় বর্তমান ছিল ব্রোঞ্জযুগের এক উন্নত নগর সভ্যতা।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে নাসিক এবং যোরবেতে হরপ্পা যুগীয় সংস্কৃতির কিছু কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সমিল মৃৎপাত্র ও ধাতুর তৈরি হাতিয়ার পাওয়া গেছে এখানে। একটা বিষয় লক্ষনীয় তা হল যতবেশি দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া যায় তত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে হরপ্পা সভ্যতার প্রভাব। প্রাচ্য ভারতের তাম্রপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কিছুটা যোগসূত্র আছে এসব সভ্যতার। খ্রীস্টপূর্ব চৌদ্দ থেকে এগারো শতকের মধ্যে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল যোরবের তাম্রপ্রস্তর যুগীয় স্তরগুলো।

“ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা পূর্ব ভারতে এক বিশিষ্ট তাম্রপ্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতি আবিস্কার করেছেন। এটি হল তথাকথিত ‘মজুত তাম্রভান্ডার’ ও ‘গেরিমাটি রঙের মৃৎপাত্র-এর সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কৃষকরা, তবে শিকার করা ও মাছধরার পেশাও তখনও পর্যন্ত তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তামার তৈরি বহুবিচিত্র ধরনের হাতিয়ার বানাতেন তারা, যেমন চেপ্টা ধরনের কুঠার, ছোট-বড় নানা আকারের বাটালি, মাছমারার কোঁচ ইত্যাদি। এই সংস্কৃতির উদ্ভব সম্বন্ধে নানা মতবাদ প্রচারিত আছে। মধ্য ভারত থেকে কিছু কিছু উপজাতি পূর্বাঞ্চলে চলে এসে এই সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করেছিল এমন একটি মতকে সমর্থন করেন কিছু কিছু পণ্ডিত, কেউ কেউ মনে করেন এই সংস্কৃতির শিকড় প্রোথিত ছিল হরপ্পা সংস্কৃতিতে, আবার সুপরিচিত প্রত্নতত্ত্ববিদ আর হাইনে গেল্ডনার মনে করেন ‘মজুত তাম্রভান্ডার’ এর সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতা ছিল কয়েকটি আর্য উপজাতি।”২

সাম্প্রতিক গবেষকদের অনুসন্ধান কার্য থেকে একথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, ‘মজুত তাম্রভান্ডার’এর সংস্কৃতিগুলো আসলে অস্ট্রিক বা মুন্ডা উপজাতিগুলোর পূর্বপুরুষদের। খ্রিস্টপূর্ব বারো ও এগারো শতকে গঙ্গাযমুনার অববাহিকা অঞ্চলের ‘মজুত তাম্রভান্ডার’ সংস্কৃতি আবার এ অঞ্চলের অনেক জনপদেই ‘রঙ করা ধূসর মৃৎপাত্র’ এর সংস্কৃতিকে জায়গা ছেড়ে দেয়। উন্নত সংস্কৃতগুলোর সংস্পর্শে আসার পূর্বে দীর্ঘদিন ‘মজুত তাম্রভান্ডার’ এর সংস্কৃতিগুলো টিকেছিল।
অতএব একথা বলা যায় হরপ্পা সংস্কৃতির মতো নগর কেন্দ্রিক কোন সভ্যতা প্রাচ্য ভারতে গড়ে ওঠেনি। এখানে যে ধরনের সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর সংস্কৃতি। বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা ভারতের প্রান্তিক জনপদ হওয়ায় এখানে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের সংখ্যা ছিল অধিক। ছত্রিশ শ্রেণীর অন্ত্যজবর্গের মানুষের বসবাস ছিল বঙ্গ ও এর প্রতিবেশী এলাকাগুলোতে। তারা ছিল সমাজ-ধর্ম মতে অচ্যুত ও দাস শ্রেণীর। বাঙালি হওয়া ছিল অসম্মানের এবং ঘৃণার। এমন কি চর্যাপদের রচনাকালীন সময়েও যে বাঙালি জাতিসত্ত্বার কোন প্রকার উন্নতি হয়নি, চর্যার পদে তারই ইঙ্গিত মেলে।
“ভুসুকু আজ বাঙালি বইলি”-কিংবা রবীন্দ্রনাথের “রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি”-উক্তির মধ্যে যে মনোদগ্ধ আক্ষেপ অনুতাপ ধ্বনিত হতে দেখা যায়, তার ভিতরে আদি বাঙালিসত্তার স্বরূপ মূর্ত হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে এর গাঠনিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ লেখক বাঙালি জাতিসত্তার বয়স পাঁচ হাজার বছরের পুরানো বলে যে অভিমত ব্যক্ত করেন তা আদৌ সঠিক বলে বিবেচিত হয় না। কারণ সেই সময়ে বঙ্গ নামে কোন ভূখণ্ডের অস্তিত্বের কোন প্রকার প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না।

আধুনিক কালে বাংলাভাষী অঞ্চল বহুবিস্তৃত। উড়িষ্যা ও আসামকে অন্তর্ভুক্ত করলে পুরো প্রাচ্য ভারতই প্রাচীন সংজ্ঞায় অভিন্ন ভাষী অঞ্চল। কিছুকাল আগেও এ অঞ্চলের আদিবাসী সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ছিল সামান্য এবং অনুমান নির্ভর। উত্তর ভারতীয় বৈদিক আর্যদের দৃষ্টিতে এরা ছিল দাস, দস্যু, নিষাদ, অসুর ও বর্বর। এদের অবয়ব শ্রীহীন, ভাষা দুর্বোধ্য, সংস্কৃতি ঘৃণ্য।
সাম্প্রতিক গবেষকদের গবেষণায় প্রাচীন ঐসব ধারণার অনেকটাই পরিবর্তন হচ্ছে। ‘বেসান্তর জাতক’-এর আলোকে সন্ধান করে জানা গেছে দুই হাজার পাঁচ শত বছর পূর্বে বৌদ্ধযুগে রাঢ় অঞ্চলে দুটি সামন্ত রাজ্য ছিল। টলেমির বর্ণনা থেকে জানা যায় এই রাজ্যদ্বয়ের একটি সিব্রিয়াম বা শিবিরাজ্য এবং অপরটি চেতরাজ্য। বৈদিক সাহিত্যেও শিবিরাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্ধমান জেলার অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে ছিল শিবিরাজ্য। এর রাজধানী ছিল জেতুত্তর নগর (মঙ্গল কোটের নিকটে শিবপুরী)। চেতরাজ্য ছিল এর দক্ষিণে। এর রাজধানী ছিল চেতপুরী। বর্তমান ঘাটাল মহকুমার ‘চেতুয়া’ এলাকা হচ্ছে প্রাচীন চেতপুরী। এই উভয় রাজ্যের অবস্থান ছিল কলিঙ্গ রাজ্যের সীমান্তে।

সেই সময়ে ভারত ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তরাজ্যে বিভক্ত। একক কেন্দ্রিয় শাসন বলতে কোনকিছু ছিল না। প্রাচ্য ভারতেও তখন অখন্ড বঙ্গদেশ গড়ে ওঠেনি। বঙ্গদেশ বিভক্ত ছিল গৌড়, রাঢ়, বরেন্দ্রী, সমতট, সুহ্ম, হরিকেল, বঙ্গ, ডবাক ইত্যাদি ভাগে। এতে ধারণা করা যায় মৌর্যবিজয়ের পূর্বেও এ অঞ্চলে সামন্ত রাজা, রাজ্য ও প্রশাসন ব্যবস্থা চালু ছিল। সুতরাং সর্বসাধারণের মধ্যে কৃষি-কুঠির ও ক্ষুদ্রশিল্প এবং বাণিজ্যিক কারবারও ছিল। টলেমি বর্ণিত প্রাচীন গঙ্গাহৃদয়কে রাঢ় বলে স্বীকার করে নিলে বুঝতে হবে রাঢ় ছিল প্রবল প্রতাপশালী রাজ্য, যাদের ছিল গজারোহী সেনাবাহিনী। এই ভয়ে অ্যালেকজান্ডার আর বঙ্গদেশ আক্রমণ করতে সাহস করেন নি।
বিজাতীয় শাসন স্থানিক মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বৌদ্ধ-জৈন-মৌর্য-শুঙ্গ-কম্ব-গুপ্ত শাসন-সংস্কৃতি বাঙালির শাস্ত্র-সংস্কৃতি ও ভাষা বিলুপ্তির কারণ হয়েছিল। পান্ডুরাজার ঢিবি উৎখনন ও বেরাচম্পার হরিনারায়ণপুরে দেগঙ্গার চন্দ্রকেতুর গড় থেকে প্রাপ্ত খিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছরের প্রাচীন নিদর্শনাদিতে এর প্রমাণ রয়েছে। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বাঙালির আত্মবিস্মৃতির জন্য মূলত উত্তর ভারতীয় শাস্ত্র-সংস্কৃতি ও প্রশাসন দায়ী ছিল। ফলত সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাঙালি মানসে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা প্রবলতর হয়নি। অর্থাৎ বাঙালির আত্মসত্তা বিজাতীয় স্রোতপ্রবাহে হারিয়ে গিয়েছিল। বিজাতীয় শাসন-শাস্ত্র-সংস্কৃতি বরণ করে নিয়ে এরকম দশা হয়েছিল আরও বেশ কয়েকটি দেশের। পশ্চিম এশিয়ার মেসোপটেমিয়া-ব্যাবিলনিয়া-আশাশিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার আলজিরিয়া-মিসর-লিবিয়া-মরক্কো প্রভৃতি দেশের নাম উল্লেখ করা যায়। ইরানও তার বর্ণ ও ধর্মমত হারিয়েছিল বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে।

Scroll to Top