ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

সকাল রাতে এখনও জমে রকের আড্ডা

মোড়ের মাথায় আলোকস্তম্ভে আটকে থাকা ছেঁড়া ঘুড়িটা আপন ছন্দে হাওয়ায় পাক খেতে থাকে। বর্ষার জল পেয়ে কার্নিশে গজিয়ে ওঠা আগাছা মনের সুখে আকাশপানে হাত মেলেছে। অপরিসর রাস্তায় টানা রিকশা আর সাইকেল ভ্যানের যানজট, পথচলতি মানুষের বিরক্তি আর নতুন কাগজের সেই গন্ধ ধরে রেখেছে আমাদের পাড়ার নিজস্ব চরিত্রটা। পাড়ার নাম বুদ্ধু ওস্তাগর লেন। ঘিঞ্জি পাড়াটা ঝাঁ-চকচকে নয়, এর আকর্ষণ লুকিয়ে সম্পর্কের উষ্ণতায় আর জীবনযাত্রার বৈচিত্রে।

শোনা যায়, বুদ্ধু ওস্তাগর ছিলেন রাজমিস্ত্রি। তাঁর নামেই এই রাস্তা। কালী সোম স্ট্রিট থেকে শুরু হয়ে বুদ্ধু ওস্তাগর লেন মিশেছে সূর্য সেন স্ট্রিটে। পাশে এক দিকে, বৈঠকখানা রোড। অন্য দিকে, অ্যান্টনি বাগান লেন।

আজকের পাড়াটা ঘিঞ্জি, কোলাহলময়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে ব্যস্ততা। অপরিসর রাস্তা এবং যানজটের কারণে এ পাড়ায় হাঁটাচলার স্বাচ্ছন্দ্য নেই। এক দিকে দোকানের সামনে যানবাহনের পার্কিং, বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি এবং পথচলতি মানুষের যাতায়াতের ফলে মাঝেমধ্যেই তৈরি হয় যানজট। বাণিজ্যিক কারণে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও হারিয়েছে পাড়া-পাড়া সে‌ই আবহাওয়াটা। তবু হারায়নি মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক আর যোগাযোগ। বাড়িতে ভাল কিছু রান্না হলে যেমন প্রতিবেশীদের বাড়িতে তা পাঠানো হয়, তেমনই যে কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে তাঁদের নিমন্ত্রণ করার অভ্যাসটাও আছে।

পাড়ার সকালটা শুরু হয় ভোরের আজানের সুরে। বেলা যত বাড়ে, বাড়তে থাকে কোলাহল। শোনা যায় হরেক ফেরিওয়ালার ডাক। শিল কাটাই, চাবিওয়ালার ছন-ছনানি, ছাতা সারাই ডাক মিশে আছে সকালের ছবিতে। বিকেলে ঘটিগরম, চানাচুর ইত্যাদি আছে পরপর।

এখানেও উন্নত নাগরিক পরিষেবা মিলছে। রয়েছে পর্যাপ্ত আলো এবং জলের জোগান। নিয়মিত দু’বার করে রাস্তা পরিষ্কার করা হলেও কিছু মানুষের নাগরিক সচেতনতার অভাবে সব সময়ে পাড়াটা পরিচ্ছন্ন থাকে না। রাত যত বাড়ে, যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ে আবর্জনাও। রাস্তার ধারে দেওয়ালগুলো পানের পিকে রঞ্জিত। আগে বর্ষায় জল জমলেও এখন তা তাড়াতাড়ি নেমে যায়। পাড়ায় আরও এক সমস্যা পার্কিং। যাঁদের গাড়ি আছে জায়গা না থাকায় তাঁদের পাড়ার বাইরে কাছাকাছি রাখতে হয়। তবুও বলব আমাদের পাড়াটা সুরক্ষিত এবং নিরাপদ। নেই কোনও ঝুট-ঝামেলা।

কাছেই বৈঠকখানা রোড আর সূর্য সেন স্ট্রিট হওয়ায় কাগজের ব্যবসা, ছাপাখানা এ পাড়াতেও প্রভাব ফেলেছে। আগেও দোকান ছিল, তবে সময়ের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পাড়াটায় বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের জন্যে একটা বাজারি এলাকা হয়ে গিয়েছে। কাটিং ও পাঞ্চিং মেশিনের সাহায্যে প্রায় প্রতিটি বাড়ির নীচে তৈরি হয় কাগজের বাক্স।

সেই ১৯৫০ থেকে এ অঞ্চলে আমাদের বসবাস। আগে থাকতাম পাশের পাড়া ছকু খানসামা লেনে। আগে এই অঞ্চলে মূলত মুসলিমরা বাস করতেন। আজও আশেপাশের পাড়ায় তাঁদের বসবাস। রয়েছে সম্প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক। এখন পাড়ায় থাকেন মূলত পূর্ব বাংলার মানুষ। সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিলেমিশে থাকার আর এক নাম পাড়া। সুখ-দুঃখে পাশে থাকার মানসিকতা আর রাত-বিরেতে যে কোনও সমস্যায় একে অপরের সঙ্গে থাকা আমাদের পাড়ার ঐতিহ্য।

পাড়ার খেলাধুলোর চলটা এখনও হারায়নি। কাছাকাছি মাঠ নেই ঠিকই, তবে ছোটরা আজও পাড়ার গলিতে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। এখানকার যুব সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ পাড়াতেই রয়েছে। কারণ অনেকেই কাগজের ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। পাড়ার অন্য আকর্ষণ মুক্তি সঙ্ঘ ক্লাবের দুর্গাপুজোটি। ঠিক যেন বাড়ির পুজোর মতো। এ ছাড়াও কালীপুজো এবং জগদ্ধাত্রী পুজোও হয়। ওই ক্লাবের উদ্যোগে হয় দুঃস্থদের মধ্যে কম্বল ও বস্ত্র বিতরণ। তেমনই এ পাড়ার ইদ, মহরম আর ইফতারও সমান আকর্ষণীয়। সময়ের সঙ্গে কিছু অবাঙালি পরিবার এলেও এ পাড়ার গুণে তাঁরাও জীবনযাত্রায় বাঙালি হয়ে গিয়েছেন। এ পাড়ায় রয়েছে অ্যাংলো অ্যারাবিক স্কুল। কাছেই সূর্য সেন স্ট্রিটে আছে নজরুল পাঠাগার। এক কালে পাড়ার অনেকেই সেখানে নিয়মিত যেতেন। আজ সেই পড়ার অভ্যাসটাও কমে এসেছে।

এ পাড়ায় এখনও সব কটিই নিজেদের বাড়ি, ফ্ল্যাট হয়নি। তবে কিছু কিছু বাড়ির চেহারা অবশ্যই বদলেছে। আছে দু’-একটি রকও। সেখানেই বসে পাড়ার আড্ডা। অনেকেই সকালে রকে বসে খবরের কাগজ পড়েন। সকালের আড্ডাটা চলে সাড়ে আটটা, ন’টা পর্যন্ত। বেলা বাড়তেই রকগুলি দখল হয়ে যায় বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। রাতের দিকে আড্ডাটা ফের বসে রকে। সব মিলিয়ে আজও অটুট এ পাড়ার আড্ডাটা। এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভাল। কাছেই শিয়ালদহ স্টেশন থাকায় রাতেও বহু মানুষের যাতায়াত লেগেই থাকে।

এ পাড়ায় এত বছর কাটিয়েছি ভাড়া বাড়িতে। অন্যত্র নিজের বাসস্থান থাকা সত্ত্বেও পাড়া ছেড়ে যেতে পারিনি। তার একমাত্র কারণ সম্পর্কের উষ্ণতা আর টান। তাকে অগ্রাহ্য করে অন্যত্র যেতে পারলাম কই? এটাই হয়তো এ পাড়ায় থাকার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

Scroll to Top