ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

ঐতিহ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব

ঐতিহ্য একটি দেশ বা জাতির প্রবহমান জীবনধারার আবেগ-অনুভূতি, যা সে জাতি বা দেশের জনমণ্ডলীকে কাল-পরম্পরা অনুযায়ী উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করে। ঐতিহ্যের সাথে ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ইংরেজি History শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘ইতিহাস’। বাংলা অভিধানে ‘ইতিহাস’ শব্দের অর্থ- ‘অতীত বৃত্তান্ত, প্রাচীন কাহিনী, পুরাবৃত্ত।’ এখানে ইংরেজি ও বাংলায় অর্থের দিক থেকে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ইতিহাস অতীতের হুবহু বিবরণ। এতে অতিরঞ্জনের অবকাশ নেই। কিন্তু ঐতিহ্য অতীতের বিষয় হলেও অতীতের হুবহু বিবরণ নয়। যেহেতু ঐতিহ্যের সাথে আবেগ-অনুভূতি জড়িত, সেহেতু এখানে কিছুটা কল্পনা ও অতিরঞ্জনের সংমিশ্রণ অস্বাভাবিক নয়। বৈশিষ্ট্যগতভাবে পার্থক্য সত্ত্বেও ঐতিহ্যের সাথে ইতিহাসের পারম্পর্য বা সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, যা সৃজনশীল প্রতিভার কল্পনাশক্তি বিকাশে ও তার সৃষ্টিকর্মে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগায়।

ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট ঐতিহ্যকে একটি বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন। বৃক্ষের দু’টি অংশ। এর একটি অংশ মাটির উপরে, অন্যটি মাটির গভীরে প্রোথিত থাকে। মাটির ওপরের অংশটি অর্থাৎ বৃক্ষের পত্র-পল্লব, শাখা-প্রশাখা, ফল-ফুল ইত্যাদি সবই দৃশ্যমান। কিন্তু মাটির নিচের অংশটি দৃশ্যমান নয়। তাই বলে সেটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মাটির গভীরে প্রোথিত মূল ও শিকড়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করে বৃক্ষ প্রাণধারণ করে, ডাল-পালা ও পত্র-পল্লবকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখে। তাই বৃক্ষ বলতে সচরাচর আমরা দৃশ্যমান অংশটিকে বুঝলেও নিচের অদৃশ্য অংশ বাদ দিয়ে বৃক্ষের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। এর অর্থ, বৃক্ষের মূল বা শিকড় বাদ দিয়ে তরতাজা সবুজ সৌন্দর্যময় বৃক্ষের কল্পনা অসম্ভব। ঐতিহ্যও তেমনি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য বৃক্ষের মূল বা শিকড়ের মতো। বৃক্ষের মত ব্যক্তি বা সমাজও ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। তাই ঐতিহ্য দৃশ্যমান না হলেও জীবন ও সমাজের অগ্রগতিতে এর অবদান অপরিসীম। প্রকৃত সৃজনশীল প্রতিভা ঐতিহ্যকে যথাযথ লালন ও নানাভাবে তা বিকশিত ও সমৃদ্ধ করে তোলে।

ব্যক্তিমানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু সমষ্টি বা একটি জাতির ইতিহাস দীর্ঘ। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য নির্মিত হয়। ঐতিহ্যকে নিরন্তর ঘষে-মেজে মসৃণ করে তুলতে হয়, নইলে একদিন তা মরচে ধরে কুশ্রী রূপ ধারণ করে, শেষ পর্যন্ত তা আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত হয়। ইতিহাস নির্মিতিতে ঘটনা পরম্পরার সঠিক বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ অপরিহার্য। ঘটনা বা তথ্যের বিকৃতি ঘটলে সেটাকে যথার্থ ইতিহাস বলা যায় না। অনুরূপভাবে, ঐতিহ্য নির্মিতিতে একটি জাতির বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, ভাষা, সাহিত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম ইত্যাদি নানা উপাদান প্রয়োজন হয়। অতএব, এর পরিসর আরো বিস্তৃত। ঐতিহ্য একটি জাতির ইতিহাস নয়, জাতির চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস, ধর্ম-সংস্কৃতি, ভাষা-সাহিত্য-শিল্পকলা, ভাস্কর্য, আবেগ- অনুভূতির ধারক। তাই এর সংরক্ষণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর লালন, পরিচর্যা ও উৎকর্ষ সাধন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ পলিমাটি অধ্যুষিত এক উর্বরা শস্য-শ্যামলা অঞ্চল। এ ব-দ্বীপ অঞ্চল অনার্য বংশোদ্ভূত মনে করা হয়, যারা আর্য নয়, তারাই অনার্য। আরো সহজভাবে বলা চলে, দ্রাবিড় বংশোদ্ভূত। আদিকালে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ধর্ম সম্পর্কেও সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না, সম্ভবত এখানে প্রকৃতি পূজার প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বহিরাগত ধর্মাবলম্বীদের আগমনে এখানকার অধিবাসীদের ধর্মে অনেক বিবর্তন ঘটে। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই।

উর্বর, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন বহিরাগতদের সর্বদাই দৃষ্টি ছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কেউ রাজ্যজয়, কেউ লুটতরাজ, কেউ বসতিস্থাপন, কেউ ধর্মপ্রচার ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যে এ দেশে আগমন করেছে। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে এসেছে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় এক ধরনের সমন্বয় সাধিত হয়েছে। এ সমন্বয় ঘটেছে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা- সংস্কৃতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে।

তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি ১১৯৯ মতান্তরে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে এ দেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েম করেন। তবে এ দেশে ইসলামের প্রচার ঘটে অনেক আগেই। সপ্তম শতাব্দীতে দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর শাসনামলে বাংলায় বিভিন্নভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটে। প্রথমে আরব বণিকদের এবং পরবর্তীতে ইসলাম প্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় প্রথমে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে ইসলামের ব্যাপ্তি ঘটে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন শিলালিপি ও স্থাপত্যকর্মের ধ্বংসাবশেষ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর ইসলামের প্রচার-প্রসার বৃদ্ধি পায়। যদিও মুসলিম শাসকগণ রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রচারের চেষ্টা করেননি, কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের বিধি-বিধান, আইন-কানুন এবং মানবিক সাম্য-ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করে। বিশেষত নিম্নবর্ণীয় নিগৃহীত ও ভেদ- বৈষম্যের শিকার দলিত শ্রেণীর মানুষ ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মানবিক আদর্শে দীক্ষিত হয়ে নতুন জীবনের সন্ধান পায়।

মুসলিম শাসনামলে (১২০৪-১৭৫৭) বাংলার শাসন-ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় বিশেষ গুণগত পরিবর্তন ঘটে। প্রথমত রাজ্য-শাসন, দ্বিতীয়ত ধর্মীয় অনুশাসন, তৃতীয়ত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা, চতুর্থত আইন-আদালত এবং পঞ্চমত ভূমিব্যবস্থা। মুসলিম আমলে শাসনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসে। ধর্মীয় অনুশাসনের ক্ষেত্রে ইসলামের মানবিক-সাম্যবাদী ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থার কারণে অমুসলিম জনগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে।

আইন-আদালতের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধান বা আইন-কানুন চালু হওয়ায় বিচারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা চালু হয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন ঘটে। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিবর্তন ঘটে ভাষার ক্ষেত্রে। সেন আমলে বাংলা ভাষাচর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। মুসলিম শাসকগণ এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে মাতৃভাষা ও সাহিত্যচর্চায় রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। এসময় আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষার অসংখ্য শব্দ বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়। ফলে এ ভাষার চর্চা করে কবি-সাহিত্যিকগণ মধ্যযুগে বিশাল সাহিত্যভাণ্ডার গড়ে তোলেন।

ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মতে, বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত আরবি-ফারসি শব্দের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে ইসলামের ধর্মীয় পরিভাষা হিসেবে প্রায় দেড় হাজার আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত হয়েছে। আরো প্রায় দেড় হাজার আরবি-ফারসি শব্দ আইন-আদালত ও ভূমি-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চালু হয়েছে। তবে বইয়ের ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষা পরে রচিত হয় সংস্কৃত পণ্ডিতদের দ্বারা, যে ভাষার সাথে তৎকালে প্রচলিত চলতি বাংলার সম্পর্ক তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। সংস্কৃত পণ্ডিতগণ বাংলা ভাষার স্বাভাবিক রূপ পরিবর্তন করে অর্থাৎ এ ভাষায় আত্তীকৃত আরবি-ফারসি শব্দ বর্জন করে সেস্থলে দুর্বোধ্য-অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ সংযোগে কৃত্রিম সাধু বাংলা চালু করলেও সাধারণ বাঙালি তা গ্রহণ করেনি।

একটি দেশ বা জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম, দর্শন, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সে দেশ বা জাতির মূল প্রাণধারা। এর ভিত্তিতে সে দেশ বা জাতির জাতীয়তাবোধ বা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়। আমাদের জাতীয়তাবোধের মূলভিত্তি খুঁজতে হবে আমাদের নিজস্ব ধর্ম-দর্শন, ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে। নিঃসন্দেহে, বিগত হাজার বছর ধরে ইসলামী আদর্শ-ঐতিহ্য ও চিন্তা-চেতনা আমাদের জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের সামাজিক আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক জীবনধারা গড়ে উঠেছে ইসলামের মূল শিক্ষার আলোকে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে এসব উপাদানের ভিত্তিতে। আমাদের ভাষার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে আমাদের জীবনযাপন ও জীবন-ভাবনাকে কেন্দ্র করে। তাই এগুলোকে লালন করার অর্থ আমাদের জীবনের বিকাশ ও জীবনের বিচিত্র সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটন করা।

ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার শাসনব্যবস্থায় শুধু পরিবর্তন ঘটেনি, বাঙালি সমাজে ও সামগ্রিক জীবনায়নে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, সেটাকে এককথায় বিপ্লবাত্মক বলা যায়। এটাকে ইউরোপের শিল্প-বিপ্লব বা বলশেভিক রাশিয়ার সমাজ-বিপ্লবের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব বহুগুণে বেশি। কারণ এ পরিবর্তন শুধু শাসক ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, শাসনব্যবস্থায় সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে অর্থনীতি, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, আইন-আদালত ও বিচারব্যবস্থায় ন্যায়নীতি ও সুবিচার নিশ্চিত করা, গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকদের শিক্ষার সুযোগ প্রদান, বর্ণ-বৈষম্যসহ সব সামাজিক ভেদ-বৈষম্য, অজ্ঞতা-কুসংস্কার দূর করে ইসলামের সমমর্যাদাপূর্ণ উদার, মানবিক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা, প্রথাগত রীতি-নীতি, আচার-আচরণের পরিবর্তে মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সুস্থ সংস্কৃতি বিনির্মাণ, ভাষা-সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিকোণ ও নান্দনিকতার উদ্ভব সমগ্র বাঙালি সমাজে তাৎপর্যময়, সুদূরপ্রসারী বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। বিশ্বাসগত পরিবর্তনের সাথে আচরণ ও সামগ্রিক জীবন-স্বভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে।

বাংলার স্থাপত্য-রীতিতে যেমন, বাঙালির খাদ্য-খানা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, উৎসব-আনন্দ ইত্যাদি সব কিছুতে পরিবর্তন ঘটেছে। অধিকাংশ বাঙালির সাহিত্যের ভাব-বিষয়-ভাষার মধ্যেও পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তিত জীবনধারায় এক নবতর সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। এটাই হলো বিগত সহস্রাধিক বছর ধরে আমাদের লালিত ঐতিহ্য।

বাংলার এ নবজাগরণ যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তাৎপর্যবহ। কারণ এর ফলে এক পুরাতন পৌত্তলিক, বহুত্ববাদী, ভেদ-বৈষম্যপূর্ণ সমাজে একত্ববাদের ভিত্তিতে এক মানবিক, সাম্য, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠেছে। আমাদের জাতীয়তাবাদ, স্বাতন্ত্র্যিক চেতনা, স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত হয়েছে। সহস্র বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এ বোধ-বিশ্বাস ও আবেগ-অভীপ্সা আর সীমাহীন ত্যাগ-সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে অবশেষে উপমহাদেশে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটেছে।

জাতীয়তার মূলভিত্তি আদর্শগত। ইসলামের মানবিক আদর্শের ভিত্তিতে সহস্র বছর ধরে গড়ে ওঠা আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি তাই অত্যন্ত সুদৃঢ় ও জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। এ সম্পর্কে সচেতনতাবোধ প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সর্বত্র প্রাচীন ঐতিহ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অনেক ঐতিহ্য আমরা সংরক্ষণ করেছি, অনেক কিছু এখনো অরক্ষিত ও দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে। তেমনি একটি অরক্ষিত-উপেক্ষিত ঐতিহ্য হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বর্তমানে ‘মধুর ক্যান্টিন’ নামে পরিচিত ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ। এককালে এটি নবাবদের বাগানবাড়িতে বিলাসকুঞ্জ হিসাবে নির্মিত হয়। এখানে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ্র আহ্বানে সাড়া দিয়ে উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ জমায়েত হয়েছিলেন তৎকালীন পরাধীন, অধঃপতিত, বঞ্চিত-নির্যাতিত মুসলিম সমাজের উন্নয়নের পথনির্দেশনা দিতে। তিন দিনব্যাপী সে সম্মেলনে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে উপমহাদেশের মুসলিমদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়। মুসলিম লীগের আন্দোলনের ফলে উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করে। তাই এ ঐতিহাসিক ভবনটি জাতীয় জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা এবং এর ইতিহাস তুলে ধরা আমাদের জাতীয় কর্তব্য।

বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম-বিশ্বাস, শিল্প-সংস্কৃতি- স্থাপত্য ও সামাজিক আচার-আচরণ বিনির্মিত হয়েছে ইসলামের গৌরবদীপ্ত ঐতিহ্যের আলোকে। শিল্প-সাহিত্য, জীবন-ভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে ইসলামী তৌহিদি চিন্তার আলোকে। তাই জাতীয় সংহতি সুদৃঢ়করণ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার অপরিহার্য তাগিদে এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য ধারণ, লালন ও পরিচর্যা একান্ত অপরিহার্য।

লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ,
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

Scroll to Top